চলনে-বলনে একজন পুরোদস্তুর তথ্যসমৃদ্ধ মানুষ তিনি। সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় মানুষটির নাম নাফিস সেলিম। তাকে বলা হয় ‘কন্টেন্ট ক্রিয়েটর’। নাফিসের কন্টেন্টের জনপ্রিয়তা পাওয়ার মূল কারণ হলো মার্কেটিংয়ের নানা বিষয়ের ভেতরে চমৎকারভাবে প্রবেশ করা। তিনি সহজেই দর্শকের সামনে হাজির হন। সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তার কথা হয় কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বেনজির আবরার—

জাগো নিউজ: প্রথমেই আপনার শৈশব সম্পর্কে বলুন—
নাফিস সেলিম: আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা রাজশাহীতে। সেখানেই ও লেভেল এবং এ লেভেল শেষ করেছি। তারপর ইউএসএ থেকে মার্কেটিংয়ের ওপর পড়াশোনা করি। ছোটবেলা থেকেই আমার বিজনেসের প্রতি ঝোঁক ছিল। যেমন ক্লাস থ্রিতে আমি গ্রিটিংস কার্ডের বিজনেস শুরু করি। ওগুলো নিজে বানিয়ে কাজিনদের মাঝে ১ টাকা, ২ টাকা, ৫ টাকা দরে বিক্রি করতাম। এর পাশাপাশি চকলেট বিক্রি থেকে শুরু করে নিজে স্যান্ডুইচ বানিয়েও বিক্রি করেছি। এমনকি পকেমন কার্ডও বিক্রি করেছি ওই বয়সে। তবে সেগুলোতে তেমন সফল হইনি। কারণ আমি সব সময় এক্সটার্নাল জায়গা থেকে বাধা পেয়েছি। আর দশটা সাধারণ মায়ের মতো আমার মাও আমাকে নিয়ে প্রচণ্ড টেনশন করতেন। তিনি মনে করতেন, এগুলো করলে আমার টাকার প্রতি নেশা চলে আসতে পারে। বাংলাদেশের কালচারে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের বাবা-মায়েরা অনেক প্রোটেকটিভ এবং কেয়ারিং। আমাদের বাবা-মায়েরা যা দেখেছেন বা শিখেছেন, আমাদের তা-ই করতে বলবেন—এটাই স্বাভাবিক।

জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা সম্পর্কে জানতে চাই—
নাফিস সেলিম: এখানে একটা ঘটনা আছে। আমার ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল সায়েন্স। আমি যখন ইউএসএতে যাই; তখন বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়া শুরু করেছিলাম বাবা-মাকে খুশি করার জন্য। তবে আমার ছোট মামা সব সময় বলতেন, ‘নাফিস তুই বড় হয়ে কোনো না কোনোভাবে বিজনেসের সাথে জড়িয়ে যাবি। কারণ এটা তোর রক্তের মধ্যে। তোর বাপ-দাদা সবাই ব্যবসার সাথে জড়িত।’ যাই হোক, আমি দেশে ও লেভেল এবং এ লেভেল শেষ করে ইউএসএতে পড়তে চলে গেলাম। কিন্তু তখনও আমার মনের মধ্যে বিজনেসের ভূতটা চেপে বসেছিল। তা-ও ভয়ে আব্বুকে বলতে পারতাম না। কারণ আমার আব্বু একটা কথা বলতেন, ‘নাফিস বিবিএতো গরু-ছাগলরাও পারে।’ তারপরও আমি বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে সুইচ করে বিজনেস এবং মার্কেটিংয়ে আসার চেষ্টা করতাম। আমি সব সময় কলেজের বিজনেস টিমের সঙ্গে কাজ করতাম। এমনও হয়েছে, ক্লাস বাদ দিয়ে সারাদিন ওখানেই পড়ে থেকেছি। তারপর ধীরে ধীরে অনেকটা রিস্ক নিয়ে মার্কেটিংয়ে পড়াশোনা শুরু করি। আমার ফ্যামিলি যেহেতু বিজনেসের সাথে জড়িত; যেহেতু ব্যবসার অনেক জিনিস আমার রক্তে ছিল। তা ছাড়া ছাত্রাবস্থায়ই অনেক ছোটখাটো বিজনেস এবং বিভিন্ন কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। বিধায় বাস্তব অভিজ্ঞতা পড়াশোনায় অনেক হেল্প করেছে। এমনও হয়েছে, ক্লাসে এসে জানতে পেরেছি আজকে কুইজ। আমি জাস্ট ১০ মিনিট পড়ায় চোখ বুলিয়ে কুইজ দিয়ে হায়েস্ট নম্বরও পেয়ে যেতাম।

জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে চলে এলেন কেন?
নাফিস সেলিম: আমার মনে হয়, আমি বাংলাদেশের একমাত্র লোক যে আমেরিকার গ্রিন কার্ড ক্যানসেল করে বাংলাদেশে সেটেল হয়েছি। এর পেছনে একটা উদ্দেশ্য আছে। আমি নেক্সট ১০ বছরে অন্তত ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে চাই। আমাদের দেশে অনেক সমস্যা আছে। সেটা খুব ভালোভাবেই জানি। কিন্তু সেটা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। সমস্যায় অতিষ্ট হয়ে সবাই যদি দেশের বাইরে সেটেল হয়ে যাই, তাহলে কোনো সমাধান তো হবেই না বরং আরও বেড়ে যাবে। বলতে পারেন, আমি যুদ্ধে নেমেছি। যুদ্ধটা আমাদের নিজের সঙ্গে। আমি দেখিয়ে দিয়ে চাই, আমরা বাংলাদেশিরাও পারি। বাংলাদেশ অনেক সম্ভাবনাময় একটা দেশ। যদি তা-ই না হতো, তবে বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এ দেশে এত ভালো করছে কীভাবে? এমনকি টেলিনরের সবচেয়ে প্রফিটেবল বিজনেস হচ্ছে বাংলাদেশে। তারা কী দেখছে, যেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না? আমি মনে করি, পুরো মাইন্ডসেটটা যদি বদলাতে পারি, তাহলে আমরাও তাদের টক্কর দিতে পারবো। আমাদের দেশের প্রবলেমগুলো নিজেরা মিলে যদি সলভ করতে থাকি, তাহলে পরে অনেক বড় স্কেলে সুফল পাবো। সে জন্য আমাদের প্রচুর খাটতে হবে। আমি বাংলাদেশে বসেই তরুণদের সঙ্গে নিয়ে সে জিনিসটা করে দেখাবো।

 

জাগো নিউজ: কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের কাজ শুরু করলেন কেন?
নাফিস সেলিম: আমি কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের সঙ্গে জড়িত ২০১৪ সাল থেকে। তখন আমার আরেকটি চ্যানেল ছিল। সে সময় বাংলাদেশে কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ছিল না বললেই চলে। হাতেগোনা কয়েকজন কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমি একটি জিনিস লক্ষ্য করলাম, আমাদের কাছে একটি টাইম মেশিন আছে। আসলেই আমাদের কাছে একটি টাইম মেশিন আছে। টাইম মেশিনটা কেমন, পশ্চিমের দেশগুলোতে যা আজ হবে, সেটাই সাউথ এশিয়ান দেশগুলোয় হবে তার ঠিক দশ বছর পর। কিন্তু আমরা সেটা দেখতে পাই না। এটাই আমাদের সমস্যা। জিনিসটি যে বুঝতে পারবে; সেই তার সুবিধা নিতে পারবে। ২০১৪ সালে শুরু করার পর আমি ইউটিউবে রেগুলার ছিলাম না। ২০১৯ সালে বন্ধও করে দিই। তারপর ২০২১ সালে আবার নতুন করে শুরু করি। মার্কেটিং আর বিজনেসের প্রতি আমার ঝোঁক তো ছিলই। আমি দেখলাম মার্কেটিং আর বিজনেস নিয়ে বাংলাদেশে তেমন কেউ সেভাবে কথা বলে না। আমি চেয়েছিলাম, বিজনেস আর মার্কেটিংয়ের সব কঠিন কঠিন ব্যাপারও খুব সাধারণ করে বাংলাদেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে। এক বছরের মধ্যে মোটামুটি একটা জায়গায় এসেছি, এখনও অনেক কাজ বাকি।

জাগো নিউজ: আপনার ধারাবাহিক নানা ধরনের কন্টেন্ট বেশ সমাদৃত। আপনার বানানো সবচেয়ে পছন্দের কন্টেন্ট কোনগুলো?
নাফিস সেলিম: আমার পছন্দের কন্টেন্টগুলো প্রায় সবই। সত্য বলতে, আমি এমনই কন্টেন্ট বানাই; যার সবগুলোই আমার নিজের কাছে ভালো লাগে। তবে নিউরো মার্কেটিংয়ের একটি কন্টেন্ট বানিয়েছিলাম। যেটা আমার কাছে অনেক ভালো লেগেছিল। যদিও এটার রিচ অত বেশি নয়। একটু ডিপে যাওয়ার কারণে সাধারণ মানুষ এটা বুঝতে পারেনি। তবে নিউরো মার্কেটিং খুবই মজার এবং ইন্টারেস্টিং একটি টপিক। এটা মূলত এফএমআরআই স্ক্যান করে বিভিন্ন কোম্পানি বা ব্র্যান্ডস তাদের কাস্টমাররা কী পছন্দ করছে আর কী পছন্দ করছে না, সেগুলো দেখে থাকে। যেমন আমরা একটি ব্র্যান্ডের ফন্টের কালার নিজেদের মতো ঠিক করে কাস্টমারদের উপরে সার্ভে করলাম। কিন্তু কাস্টমারদের সার্ভেতে পজিটিভ সাইন এলেও পরে দেখা গেল সেই ফন্ট আসলে তারা পছন্দ করেনি। আমরা যদি কাস্টমারদের ব্রেইন স্ক্যান করি, তবে অ্যাকচুয়াল তথ্য বা ইনফরমেশনটা পাওয়া যাবে। এটাই নিউরো মার্কেটিং।

 

জাগো নিউজ: তথ্যভিত্তিক কন্টেন্ট প্রচুর মানুষ দেখছে, বিষয়টি দারুণ পজিটিভ। আপনি কতটা উপভোগ করছেন?
নাফিস সেলিম: আমি প্রথমদিকে তথ্যভিত্তিক কন্টেন্ট বানাতে ভয় পাচ্ছিলাম। কারণ এ টপিক রিলেটেড কন্টেন্ট মানুষ আদতেই দেখবে কি না, কতটুকু পজিটিভলি নেবে, এটা তো বিনোদনমূলক কিছু না। তবে আমি কিছুটা সাহস পেয়েছিলাম এনায়েত চৌধুরী, খালিদ ফারহান, সিয়াম আহমেদ নূরকে দেখে। তাদের তথ্যভিত্তিক কন্টেন্টগুলো ভালোই সাড়া ফেলেছিল। বুঝতে পারলাম, পড়াশোনা বা তথ্যবিষয়ক ইনফরমেশনগুলো জানতে মানুষ এখন আগ্রহী। প্রথমদিকে কিছুটা ভয় পেলেও বর্তমানে অনেক উপভোগ করছি। যখন দেখি, একজন তরুণ এ ধরনের তথ্যভিত্তিক কন্টেন্ট দেখে। এ জিনিসগুলো আসলেই আমার খুব ভালো লাগে। কারণ তারা ইনফরমেশন কনজিউম করছেন। আপনার ব্রেইন সেটাই চিন্তা করবে; যেটা আপনি কনজিউম করছেন। আপনি যদি গান কনজিউম করেন, তবে আপনার ব্রেইন গানই চিন্তা করবে। আমাদের তরুণরা যে এডুকেশন ভিত্তিক কন্টেন্টের দিকে ঝুঁকছেন, ব্যাপারগুলো আসলেই আমাকে অনুপ্রাণিত করে।

জাগো নিউজ: এ ধরনের ভিডিও নির্মাণে আপনার প্রতিমাসে কী পরিমাণ আয় হয়?
নাফিস সেলিম: আয় মোটামুটি ভালোই হয়। কিন্তু ব্যয় অনেক বেশি। আয় বলতে কোনো মাসে বেশি আবার কোনো মাসে কম। তবে আমি বলব, আয় এভারেজে সিক্স ফিগার থাকে।

 

জাগো নিউজ: নতুন যারা এ ধরনের তথ্যভিত্তিক ভিডিও তৈরি করেন, তাদের বাধার জায়গা কোনগুলো?
নাফিস সেলিম: আমার মনে হয়, তথ্যভিত্তিক কন্টেন্ট সেক্টরে তেমন মানুষ নেই। অনেক বেশি তরুণকে এ সেক্টরে আসা উচিত। তবে কেউ কখনো কাউকে ফলো করবেন না। অনেকেরই এমন হয় যে, কেউ কোনো একটা জিনিস নিয়ে কাজ করছে, আমরা জাস্ট ঘুরিয়ে-পেচিয়ে সেটাকে কপি পেস্ট করে দিই। এটা করবেন না। চেষ্টা করবেন কোন জিনিসটার প্রতি আপনাদের আগ্রহ বেশি কিংবা কোন টপিকটা আপনাকে টানে। অন্যরা কে কী করছেন সেটা দেখার দরকারই নেই। এটি আপনার জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। আপনারা যদি কখনো কন্টেন্ট বানাতে চান, তবে চেষ্টা করবেন সপ্তাহে অন্তত একটি করে ভিডিও আপলোড করার। প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হবে। কিন্তু তাও কাজটি আপনাকে করতে হবে। আরেকটি জিনিস সব সময় মাথায় রাখতে হবে, অনলাইনে প্রচুর মানুষ আপনাকে ট্রল করবে কিংবা নেতিবাচক মন্তব্য করবে। মূলত তাদের কাজই হলো ট্রল করা। তাদের কথায় কান দেওয়া যাবে না। তবে যারা গঠনমূলক সমালোচনা করবেন, তাদের কথা আমলে নিতে হবে। তারাই আপনার মূল অডিয়েন্স। এককথায় আপনার আইডেনটেটি হারানো যাবে না। প্রথম ভিডিও যেমন হবে, ১০০ নম্বর ভিডিও তারচেয়ে হাজার গুণ ভালো হবে। এটি অনেকটা কোনো স্কিল অর্জন করার মতো। আপনি ভুল করতে করতেই শিখবেন। আমিও প্রথম প্রথম ইনসিকিউরিটিতে ভুগতাম, ভাবতাম কোনো ভুল করলে অডিয়েন্স কী বলবে? পরে দেখলাম, আসলে তেমন কেউই কিছু বলে না। জাস্ট সাহস করে এগিয়ে যেতে হবে। আপনাকে বেস্ট বা পারফেক্ট জিনিসটাই দিতে হবে এমন মানে নেই। আপনার যদি মনে হয়, এটার বেজ দাঁড়িয়ে গেছে; আপনি পুরোপুরি বুঝতে পারছেন। তাহলে সেটাই আপলোড করে দিন। আমার কথা বিশ্বাস না হলে যে কোনো চ্যানেলে যান। দেখবেন তাদের প্রথম আর লেটেস্ট ভিডিও কখনোই সেইম হবে না। হিউজ একটা পার্থক্য থাকবেই। বলতে পারেন, আকাশ-পাতাল তফাৎ। তবে আমি চেষ্টা করেছিলাম প্রথম থেকেই কোয়ালিটি মেইনটেইন করার। কারণ আমার আগে থেকেই কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের অভিজ্ঞতা ছিল। আমি জানতাম কীভাবে কী করতে হবে। তারপরও আমাকে অনেক কষ্ট এবং ইনভেস্ট করতে হয়েছে।

জাগো নিউজ: কন্টেন্টে উন্নতি করতে কী করা প্রয়োজন?
নাফিস সেলিম: আমার একটি টিম আছে, সেই টিম নিয়েই আমি কাজ করি। আমার ফিলোসফি এবং বিজনেস মডেল যেহেতু আলাদা; সেহেতু বলতে পারেন আমি রীতিমতো রিস্ক নিয়েই শুরু করেছি। আপনাকে যেটা করতে হবে, অনেক রিসার্চ করতে হবে, অনেক স্টাডি করতে হবে। দেখা গেল, আপনি ভিডিও দিতেই আছেন, দিতেই আছেন। কিন্তু কোনো উন্নতি হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে আপনাকে ভুলটা খুঁজে বের করে স্ট্রাটেজিকালি আগাতে হবে। তাহলেই আপনি কন্টেন্টে উন্নতি করতে পারবেন।

সূত্র-  জাগো নিউজ