উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

অনেক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে বিশ্বজুড়ে গত কয়েক শতকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও সদূরপ্রসারী যে মন্দাটি ঘটবে বাংলাদেশেও তার বিরাট এক ক্ষতীকর প্রভাব পড়বে। এতে বাংলাদেশের সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। শিল্পোৎপাদন, পণ্য বিক্রি ও জনগণের আয় কমে যাবে এবং কর্মী ছাঁটাই, বেকারত্ব ও দরিদ্রতা, দারিদ্র বৃদ্ধি পাবে।

বৈশ্বিক অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক এক পূর্বাভাসে ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) বাংলাদেশ সমন্ধে বেশ ইতিবাচক ভবিষ্যতবানী করেছে। ২০২১ সাল নাগাদ রাষ্ট্রসমূহের জিডিপি বৃদ্ধির হারের যে তালিকা তারা তৈরী করেছে সেখানে সবচেয়ে ভাল অবস্থান দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৯ সালে ৭.৯ % জিডিপি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল বাংলাদেশ যা ২০২০ সালে করোনা সম্পর্কিত সমস্ত সঙ্কটের মধ্যেও ২ % ধরে রাখতে পারবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসও প্রায় অনুরূপ। তারা ২-৩ শতাংশের কথা বলেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এটি হবে যথাক্রমে -৫.৯; ১.২; ১.৯ ও -১.৫। ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার হতে পারে ৯.৫ %। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এটি হবে যথাক্রমে ৪.৭; ৯.২; ৭.৪ এবং ২.০।[১]

১ জুন প্রকাশিত; ব্র্যাক, ডেটা সেন্স ও উন্নয়ন সমন্বয়-এর এক যৌথ সমীক্ষা ও জরীপে জানা গেছে যে, চলমান মহামারী সঙ্কটের কারনে বাংলাদেশের ৭৪% পরিবারের উপার্জন কমে গেছে এবং ১০ কোটি ২২ লাখ মানুষ অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে পড়েছেন। এছাড়াও ১৪ লাখেরও বেশি বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন বা আসছেন।

সমীক্ষার জানা গেছে, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ চরম দরিদ্র (যাদের দৈনিক আয় ১.৯ ডলার), যাদের মধ্যে নতুন করে চরম দরিদ্র হয়ে পড়া পরিবারগুলোও রয়েছে। উচ্চ অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে রয়েছে এমন চরম দরিদ্র ব্যক্তির সংখ্যা ৪ কোটি ৭৩ লাখ এবং উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা ৩ কোটি ৬৩ লাখ।

সমীক্ষায় যেসব পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৩৪.৮% পরিবারের কমপক্ষে ১ জন সদস্য চাকরি হারিয়েছেন এবং মার্চ-মে মাসের মধ্যে গড় পারিবারিক উপার্জন প্রায় ৭৪ % কমে গেছে।

তৈরি পোশাক খাতে (গার্মেন্টস) রপ্তানি এপ্রিল ২০১৯-এর তুলনায় ২০২০ সালের এপ্রিলে ৮৪ % কমে গিয়েছে। ২০২০ সালের মার্চের মাঝামাঝি থেকে ৭ এপ্রিলের মধ্যে ১,১১৬টি কারখানা বন্ধ হয়েছে এবং চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ২২ লাখ পোশাক শ্রমিক।

সমীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে যে, নিম্নআয়ের মানুষের এই রোগের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি আছে। এছাড়াও এসব পরিবারের উপার্জনশীল সদস্যের মৃত্যু হলে তখন নারী ও শিশুদের মধ্যে অনাহার এবং অপুষ্টির শিকার হওয়ার উচ্চ আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। দেশব্যাপী সমন্বয়ের অভাবের কারণে দরিদ্র ও অতিদরিদ্রদের কাছে সরকারের দেওয়া খাদ্য এবং নগদ সহায়তা সঠিকভাবে পৌঁছাচ্ছে না বলে দাবী করা হয়েছে।

চলমান মহামারী সঙ্কট বাংলাদেশে নতুন ধরনের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং ডিজিটাল বিভাজন সৃষ্টি করেছে। জানা গেছে যে, বাংলাদেশে কেবলমাত্র ৩৪ % পরিবারের কাছে স্মার্টফোন রয়েছে এবং ৫৪ % পরিবারের টেলিভিশন দেখার সুযোগ রয়েছে, যার ফলশ্রুতীতে বহুসংখ্যক শিশু ডিজিটাল মাধ্যমে পরিচালিত শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে।

কিছু বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়েছেন, বাংলাদেশের ৭৮ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থীকে যে ১০০ টাকা করে বৃত্তি দেওয়া হয়ে থাকে তা জরুরীভিত্তিতে এখনই ৫০০' টাকায় উন্নীত করা যেতে পারে। এই পদ্ধতিতে সঠিক জায়গায় সহায়তা পৌঁছানোর ব্যাপারটা অনেকটা নিশ্চিত করা যেতে পারে।[২]

 

সামাজিক অস্থিরতা ও সহিংসতা[সম্পাদনা]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মাইক্রোগভর্নেন্স রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের যৌথভাবে কৃত এক জরিপের প্রতিবেদনে জানা গেছে যে, বাংলাদেশে ১০ মার্চ-৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সর্বোমোট ১,৪১৬ টি আর্থ-সামাজিক দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে মার্চে ৩৪৭টি এবং এপ্রিলে ১,০৬৯টি। মার্চের প্রথম সপ্তাহে অস্থিরতা-সহিংসতার ঘটনা ছিল মাত্র ৯টি যা এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ নাগাদ এসে ৩৮৩টি ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। এসব ঘটনা সর্বাধিক বেশি ঘটেছে চট্টগ্রাম বিভাগে (২০.৫%)।

জেলা পর্যায়েও সামাজিক অস্থিরতার দিক থেকে ১ম স্থানে রয়েছে চট্টগ্রাম (৮৯টি ঘটনা)। ২য়, ৩য় এবং ৪র্থ স্থানে রয়েছে যথাক্রমে বরিশাল (৬১টি ঘটনা), হবিগঞ্জ (৫৮টি ঘটনা), ঝিনাইদহ (৫৫টি ঘটনা)। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘটেছে মাত্র ২০টি ঘটনা।

শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে সামাজিক অস্থিরতার ঘটনা বেশি ঘটেছে। শহরাঞ্চলে ঘটেছে ৪০.৯৬% এবং গ্রামাঞ্চলে ঘটেছে ৫৯.০৪%।

এসব সংঘর্ষ ও সহিংসতার মাত্র ২৫.৫৯% ঘটনার সঙ্গে সাধারণ মানুষ জড়িত ছিল। ১৩.৫২% ঘটনার সাথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ১৭.৫৫% ঘটনার সাথে প্রশাসন, ৮.৪৪% ঘটনার সাথে রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থক, ৭.৫২% ঘটনার সাথে গ্রাম্য মাতব্বর এবং ৬.২০% ঘটনার সাথে ব্যবসায়ীরা জড়িত ছিলেন।

এসব সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত ৩৯, আহত ৪৮৬ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন ৮০২ জন।[

 

আর্থ-সামাজিক প্রভাব[সম্পাদনা]

বাংলাদেশের অর্থনীতি বিশ্বের মধ্যে ৩৯ তম এবং ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে (পিপিপি) ২৯ তম যা দক্ষিণ এশিয়ায় ২য়। বাংলাদেশ গত এক দশক ধরে গড়ে ৬.৩ শতাংশ হার ধরে রেখে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে এবং বর্তমানে বিশ্বের ৭ম দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতি। ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুসারে (পিপিপি) বর্তমানে বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপি ৪,৬০০ মার্কিন ডলার। বিশ্বব্যাংকের ২০১৯ সালের তথ্যানুসারে বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তি ৭,০০,০৯,৩৫৩ জন।[৬][৭][৮]

২০১৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৩১৭.৪৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০২০ সালে (ক্রয়ক্ষমতার ভিত্তিতে অনুমিত) ৮৬০.৯১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।[৯][১০]

২০১৮, ২০১৯ সালে জিডিপির হার ছিল যথাক্রমে ৮ % এবং ৭.৯ %। ২০২০, ২০২১ সালে সম্ভাব্য হার হবে যথাক্রমে ২ % ও ৯.৫ %।[১০]

বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি আসে প্রধানত ৫ টি খাত (উৎপাদন, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, পরিবহন, নির্মাণ এবং কৃষি) থেকে এবং গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) জিডিপিতে ৬৭ শতাংশ (সাড়ে সাত লাখ কোটি টাকা) অবদান রেখেছে এই খাতগুলি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্যানুসারে গত অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮.১৫ %, স্থিরমূল্যে যা ১১,০৫,৭৯৩ কোটি টাকা।[১১]

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমান্বয়ে কৃষির তুলনার 'সেবা' ও 'শিল্প' খাত থেকে বাংলাদেশ বেশি পরিমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছে। ২০১৮ সালের তথ্যানুসারে 'সেবা', 'শিল্প' ও কৃষি খাতে বাংলাদেশের জিডিপি যথাক্রমে ৫২.১১; ৩৩.৬৬ এবং ১৪.২৩%।[১২][১৩]

বর্তমানে 'বিদেশি আয়' (রেমিট্যান্স) এবং 'তৈরী পোশাক শিল্প' (গার্মেন্টস) বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। যদিও তৈরি পোশাক শিল্প (রপ্তানি) থেকে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে কিন্তু একইসাথে বিদেশ থেকে এর কাঁচামাল ক্র‍য়ে খরচ থাকার কারনে এককভাবে অভিবাসন খাতই (রেমিট্যান্স) বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম উৎস। আবার, বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে বেশি পরিমানে আমদানি করার কারনে,বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যে ঘাটতি ঘটে তা প্রধানত 'রেমিট্যান্স' এর মুদ্রা ব্যবহার করে মেটানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশ 'প্রবাসী আয়ের' (রেমিট্যান্স) মাধ্যমেই প্রধানত তাদের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন (বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ) বাড়িয়ে থাকে। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী বেশি রেমিট্যান্স আসা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯ম।[১৪]

২০১৯ সালে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৭৬৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকা (১,৮৩৩ কোটি মার্কিন ডলার) যা ২০১৮ সালের তুলনায় ২০ শতাংশ বেশি। ২০১৮, ২০১৭, ২০১৬ ও ২০১৫ সালে রেমিট্যান্স এসেছে যথাক্রমে ১,৫৫৩, ১,৩৫৩, ১,৩৬১ ও ১,৫৩১ কোটি মার্কিন ডলার।[১৫]

বাংলাদেশে প্রতিবছর ইদের পূর্বে বেশি পরিমানে রেমিট্যান্স আসে এবং ২০২০ সাল থেকে সরকার প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এর উপর ২ শতাংশ হারে (১০০ টাকায় ২ টাকা) প্রণোদনা দিচ্ছে।[১৬]

বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১৬ শতাংশ পূরণ করে 'তৈরী পোশাক শিল্প' (গার্মেন্টস) খাত যা বাংলাদেশের গত বছরের সর্বোমোট রপ্তানির ৮৩ % (৩,০০০ কোটি টাকা)।[১৭][১৮]

বিশ্বে রপ্তানী আয় অর্জনের ক্ষেত্রে বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ছিল ৪২ তম। ২০১৮ সালে বৈশ্বিক পোশাক বাজারে বাংলাদেশের অংশ ছিল ৬ শতাংশ এবং পোশাক রপ্তানিতে একক দেশ হিসেবে বিশ্বে ২য়। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পণ্য ও সেবা রপ্তানি খাতের অবদান ছিল ১৪.৬ %।[১৯] যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংগঠন ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল এর হিসাব মতে তৈরি পোশাক শিল্পে বিশ্বের প্রথম সারির ১০টি উন্নতমানের (পরিবেশবান্ধব) কারখানার ৭টি'ই রয়েছে বাংলাদেশে।[২০]

২০১৯ সালের বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে, কৃষিতে নিয়োজিত বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তি ৪০.৬ %। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুসারে বাংলাদেশের ৪৬.৬১ শতাংশ খানা (পরিবার) কৃষির উপর নির্ভরশীল।[২১]

কৃষি ও বনায়ন খাত থেকে বাংলাদেশের জিডিপি'র ১০ শতাংশের বেশি অর্থ আসে যা টাকার অঙ্কে ১,০৭,০০০ কোটি। গত অর্থবছরে ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে ৭৫,০০০ কোটি, গবাদিপশু পালনের মাধ্যমে ১৫,০০০ কোটি এবং বনায়ন এর মাধ্যমে ১৭,০০০ কোটি টাকা।[১১] [২২]

অনেক অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতবানী করেছে যে করোনাভাইরাসের অতিমারীর কারনে বিশ্বজুড়ে গত কয়েক শতকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ও সদূরপ্রসারী যে মন্দাটি ঘটবে বাংলাদেশেও তার বিরাট এক ক্ষতীকর প্রভাব পড়বে। এতে বাংলাদেশের সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। শিল্পোৎপাদন, পণ্য বিক্রি ও জনগণের আয় কমে যাবে এবং কর্মী ছাঁটাই, বেকারত্ব ও দরিদ্রতা, দারিদ্র বৃদ্ধি পাবে।

বর্তমানে বিশ্বের পূর্ণ বা খণ্ডকালীন মোট কর্মশক্তির প্রতি ৫ জনের মধ্যে ৪ জনের পেশাই কোন না কোনভাবে করোনা অতিমারীর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে বৈশ্বিক অর্থনীতির ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত সাম্প্রতিক এক পূর্বাভাসে ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) বাংলাদেশ সমন্ধে বেশ ইতিবাচক ভবিষ্যতবানী করেছে। ২০২১ সাল নাগাদ রাষ্ট্রসমূহের জিডিপি বৃদ্ধির হারের যে তালিকা তারা তৈরী করেছে সেখানে সবচেয়ে ভাল অবস্থান দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৯ সালে ৭.৯ % জিডিপি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল বাংলাদেশ যা ২০২০ সালে করোনা সম্পর্কিত সমস্ত সঙ্কটের মধ্যেও ২ % ধরে রাখতে পারবে বলে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসও প্রায় অনুরূপ। তারা ২-৩ শতাংশের কথা বলেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এটি হবে যথাক্রমে -৫.৯; ১.২; ১.৯ ও -১.৫। ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার হতে পারে ৯.৫ %। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এটি হবে যথাক্রমে ৪.৭; ৯.২; ৭.৪ এবং ২.০।[১]

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সমীক্ষার তথ্যানুসারে ২৬ মার্চ-২৬ এপ্রিল (৩০ দিন) পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি ১,০০,০০০ কোটি টাকারও বেশি। লকডাউনের কারনে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে গড়ে প্রতিদিন মোট ক্ষতী প্রায় ৩৩০০ কোটি টাকা যা লকডাউন অবস্থার মেয়াদ বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিমানে বাড়তে পারে। সমীক্ষা অনুসারে, যদি পুরো মে মাস লকডাউন থাকে সেক্ষেত্রে ক্ষতীর পরিমাণ ২,০০,০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে দাবী করা হয়েছে যা পরিমানে গত অর্থবছরের জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশ।[২৩]

শিল্প (উৎপাদন ও নির্মাণ), সেবা ও কৃষি খাতে প্রতিদিন ক্ষতী হচ্ছে যথাক্রমে ১,১৩১; ২০০০ এবং ২০০ কোটি টাকা। [২৩]

১৯ এপ্রিল পর্যন্ত পাওয়া তথ্যানুসারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও রফতানিমুখী দুই ধরনের অর্থনীতিতেই স্থবিরতা দেখা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এর প্রভাব শিঘ্রই চাকরির বাজারেও পড়বে যার ফলে বিপুল সংখ্যক কর্মজীবী মানুষ কর্মচ্যুত হবেন।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলেছে, করোনাভাইরাস কারণে আগামী তিন মাসের মধ্যে বিশ্বে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ তাদের পূর্ণকালীন চাকরি হারাবেন যার মধ্যে সাড়ে ১২ কোটি মানুষই বসবাস করেন এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে। আর, দাতা সংস্থা অক্সফামের গবেষণায় দাবী করা হয়েছে এ অঞ্চলের ১৩ কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়বে। আইএলও এর তথ্য অনুযায়ী আবাসন ও খাদ্যের পাশাপাশি নির্মাণ, খুচরা বিক্রি, ব্যবসা এবং প্রশাসনিক খাতগুলোও বিশেষ ঝুঁকিতে রয়েছে।[২৪]

বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের হিসাব মতে, করোনা অতিমারীর কারনে বাংলাদেশে অন্তত দেড় কোটি মানুষ তাদের চাকরি হারাবেন এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বেন অন্তত ৫ কোটি মানুষ (প্রতি পরিবারে গড়ে ৪ জন করে সদস্য ধরা হয়েছে)।

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র বলেছে যে শতাধিক কারখানায় কর্মী ইতিমধ্যেই ছাটাই করা হয়েছে। আরেক উৎসে যানা যায় যে, কারখানা কর্তৃপক্ষ অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদেরও স্বেচ্ছায় অন্তত ছয়মাসের ছুটিতে যেতে বলা হয়েছে।[২৫]

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে এর (বিআইজিডি) একটি যৌথ গবেষণায় জানা গেছে যে এই অতিমারীর কারনে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতীর সম্মুখীন হবেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা এবং বাংলাদেশে দারিদ্রতার প্রবণতা বাড়তে থাকবে। শহরের মধ্যে রিকশাচালক, দিনমজুর, গৃহপরিচারিকা, রেস্টুরেন্টকর্মী, ক্ষুদ্র ভাসমান ব্যবসায়ী, অটোচালক এবং গ্রামের মধ্যে কৃষক, জেলে, দোকানি, বিদেশফেরত মানুষেরাও এর মধ্যে পড়বেন।

বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্পের কেন্দ্রীয় সংগঠন ‘বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল’ (বিপিআইসিসি) দাবী করেছে যে, এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ২০ লাখ ব্যক্তি সীঘ্রই বেকার হবে এবং ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই সেক্টরে ক্ষতি হবে প্রায় ৩ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০ লাখ ব্যক্তি এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে, যার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। এছাড়াও নির্ভরশীল আরো প্রায় ৩০ লাখ ব্যক্তি দারিদ্রতার মধ্যে পড়বে বলা হয়েছে।[২৬]

বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) জানিয়েছে এই অতিমারীর কারনে ব্যবসা বাণিজ্যের মতই , শ্রম বাজারের ওপরও সমান বিরূপ প্রভাব পড়বে। সাম্প্রতিক তথ্যানুসারে বাংলাদেশে সর্বোমোট ৬ কোটি ৪০ লাখ (প্রায়) শ্রমজীবী ছিলেন যার মধ্যে ২ কোটি ৪০ লাখ কৃষিতে এবং ৪ কোটি শ্রমজীবী শিল্প ও সেবা খাতে কাজে নিয়োজিত ছিলেন।

আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব মতে বাংলাদেশে ৩ কোটি ৪০ লাখ গরিব মানুষ আছেন যাদের মধ্যে পৌনে দুই কোটি মানুষ হতদরিদ্র স্তরের। বাংলাদেশ সরকার দিনমজুর, রিকশা ও ভ্যান চালক, পত্রিকার হকার, নির্মান, মোটর ও হোটেল শ্রমিকসহ অন্যান্য পেশাজীবি যারা দীর্ঘ ছুটি বা আংশিক লকডাউনের ফলে কাজ হারিয়েছে, তাদের সহায়তার জন্য ৭৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে।[২৭]

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) একটি প্রতিবেদনে বলেছে যে, নির্মাণ খাত ও খুচরা ব্যবসায়ের সাথে জড়িত শ্রমিকরা তুলনামূলক বেশি পরিমানে কাজ হারাবেন। হোটেল-রেস্তোরা, সেবা খাতের কর্মীরা বেশি কাজ হারাতে পারেন।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এর মতেও হোটেল, রেস্তোঁরা ও নির্মাণ খাতের শ্রমিকরা বিশেষভাবে ঝুঁকিতে পড়বেন।[২৫]

অতিমারীতে প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও বেকারত্ব বাড়ছে এবং এর নেতিবাচক প্রভাব প্রবাসী আয়ে (রেমিট্যান্স) দেখা যাচ্ছে। ৭ এপ্রিলের তথ্যানুসারে, গত ২ মাসে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় কমেছে তিন হাজার কোটি টাকা (৩৬ কোটি ডলার)। প্রবাসীদেরকে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে সহায়তা দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদ ও এ খাতের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ডের দেয়া তথ্যানুসারে বর্তমানে বিশ্বের ১৬০টি দেশে এক কোটিরও বেশি প্রবাসী বাংলাদেশী রয়েছেন যারা বছরে ৫৩ হাজার কোটি টাকা প্রবাসী আয় (১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স) বাংলাদেশে পাঠান। বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের অর্ধেকের বেশি এটি।[২৮]

বেসিস থেকে জানানো হয়েছে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সার ও গীগ অর্থনীতির সাথে যুক্ত ব্যক্তিরাও কাজ হারাচ্ছেন।[২৯]

আবাসন উদ্যোক্তাদের সংগঠন রিহ্যাব জানিয়েছে যে, নির্মাণ শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ৩৫ লাখ লোক কর্মসংস্থান ঝুঁকিতে আছে

 

DISCLAIMER : Views expressed above are the author's own. The contents provided here are only for educational assistance & information purposes only. Information is provided without warranty and is to be used at the risk of the reader. All trademarks, logos and copyright issues are property of their respective owners. The creator of this page takes no responsibility for the way you use the information provided on this site.