আগামী জানুয়ারি মাসে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে শুরু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। এরপর পর্যায়ক্রমে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণিতে তা বাস্তবায়িত হবে। এতে বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন এই শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকা স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী, ইউজিসি অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক হাসিনা খান। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মোশতাক আহমেদ। 

 নতুন শিক্ষাক্রম দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কতটা পরিবর্তন আনতে পারবে বলে আপনি মনে করেন? 

হাসিনা খান: বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই মুখস্থনির্ভর। এখান থেকে আমাদের শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রম অভিজ্ঞতানির্ভর হবে। আমাদের শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষায় অভ্যস্ত করার যে প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রমে, তাতে আমি খুবই আশাবাদী। এখানে শিক্ষার্থীরা চিন্তা করতে শিখবে, সমস্যার সমাধানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যে জ্ঞান অর্জন করবে, সেটি তারা তাদের জীবনে কাজে লাগাতে পারবে। শিক্ষার্থীদের আরও সৃষ্টিশীল করাই আমাদের মূল উদ্দেশ্য। এগুলো মাথায় রেখেই নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। 

আরও পড়ুন

 প্রাথমিক শিক্ষায় বৃত্তি পরীক্ষার তুঘলকি সিদ্ধান্ত

নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সর্বশেষ অগ্রগতির বিষয়ে যদি বলতেন।

হাসিনা খান: আমি শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। কিন্তু বাস্তবায়নের কাজটি করছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডসহ (এনসিটিবি) অন্যরা। সুতরাং বাস্তবায়নের অগ্রগতির তথ্যটি এনসিটিবির কাছ থেকে নিলেই ভালো হবে। তবে আমি এনসিটিবিকে যথেষ্ট আন্তরিক দেখছি। যদিও এ মুহূর্তে দেশীয় ও বৈশ্বিক একটি সংকট চলছে। সেটি হয়তো তাদের কাজ কিছুটা কঠিন করে দেবে। তবে আমাদের ওপর যে দায়িত্ব ছিল, সেটি আমরা করে দিয়েছি। 

আরও পড়ুন

 যুক্তরাজ্যের নয় বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপে পড়ার সুযোগ, আবেদন অনলাইনে

আপনার চোখে নতুন এই শিক্ষাক্রমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক কোনটি, যদি একটু বিস্তারিত বলতেন? 

হাসিনা খান: এত দিন পর্যন্ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ছিল ফলাফলকেন্দ্রিক। এই নীতিতেই পরিচালিত হয়ে আসছিল। বছরের শেষে পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হতো। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রম যেহেতু অভিজ্ঞতাভিত্তিক, তাই শিক্ষার্থীদের সারা বছর শিখনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হবে। নতুন এ পদ্ধতিতে একটি ‘রিসোর্স বুক’ তৈরি করা হচ্ছে, যেটিকে বলা হচ্ছে অনুসন্ধানী পাঠ। এর মাধ্যমে অনুশীলন বই ও শিক্ষক সহায়িকা হচ্ছে। আমার মনে হয়, নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করা থেকে বিরত রাখতে পারবে। আরেকটি বিষয় বলতেই হবে, সেটি হলো নতুন এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়ে আনন্দ পাবে। ইতিমধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হওয়া বিদ্যালয় থেকে যে তথ্য পেয়েছি, তাতে বলা যায়, শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গেই বিজ্ঞান পাঠের নতুন ব্যবস্থাটি গ্রহণ করছে। এ অভিজ্ঞতাই দেখতে পাচ্ছি। 

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষা প্রশাসনের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে একধরনের সমন্বয়ের ঘাটতি দেখা গেছে।
এমনকি প্রাথমিক স্তরে পরীক্ষামূলকভাবে নতুন শিক্ষাক্রম চালুই করা যায়নি। এখন বলা হচ্ছে আগামী বছর একেবারে সরাসরি তা চালু করবে। এতে কোনো সমস্যা তৈরি হবে বলে আপনি মনে করেন? 

হাসিনা খান: প্রথমত এটি (সমন্বয়হীনতা) কাম্য ছিল না। নতুন শিক্ষাক্রম প্রাথমিক স্তর থেকেই শুরু করতে পারত। তবে মাধ্যমিক থেকে শুরু করাতেও খুব একটা সমস্যার কারণ হয়নি। পঞ্চম শ্রেণি শেষ করে শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞানের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষাক্রমটি প্রণয়ন করেছি। এর ফলে খুব সমস্যা হয়নি। 

আরও পড়ুন

 সুইজারল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুল-ফ্রি স্কলারশিপ, প্রতি সেমিস্টারে পাবেন ১২ লাখ

নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী তৈরি বইগুলো নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী? 

হাসিনা খান: বই লেখা নিয়ে এনসিটিবি অনেকগুলো আবাসিক সভা করেছে। বিদ্যালয়, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞরা মিলে দীর্ঘ আলোচনার মধ্য দিয়েই বইগুলো তৈরি করেছেন। আমার মনে হয়, মানসম্মত বই রচনার জন্য সবাই সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তারপরও আমি মনে করি, আরও উন্নয়নের সুযোগ আছে, যা পরের বছর থেকে এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। 

আপনি বিজ্ঞানের শিক্ষক। আপনার কাছে জানতে চাই, নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা নামে বিভাগ থাকবে না, সবাইকে অভিন্ন বিষয় পড়তে হবে। একেবারে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে গিয়ে এ বিভাগ বিভাজনটি হবে। এতে অনেকেই বিজ্ঞানশিক্ষা সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কার কথা বলছেন। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী? 

হাসিনা খান: আমি কিন্তু তা (সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা) খুব একটা মনে করি না। কারণ, পৃথিবীর অনেক দেশেই শিক্ষার ভাগ হওয়াটা আমাদের দেশের মতো হয় না। আমরা যদি মানসম্মত পাঠ্যক্রম তৈরি করতে পারি, তাহলে বরং শিক্ষার্থীর পক্ষে এটি আরও ভালো হবে। আর যখন আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করবে, তখন আর সংকুচিত হওয়ার সুযোগ নেই। এখানে আরেকটি বিষয় হলো, নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে। তবে এগুলো সব শ্রেণিতে কিন্তু সমান গুরুত্ব পাবে না। আমি যত দূর মনে করতে পারছি সেটি হলো, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মাতৃভাষার ওপর এবং গণিতের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পরে ধাপে ধাপে বিজ্ঞানের গুরুত্ব বাড়বে। এর মধ্যে দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞানের ওপর বেশি সময় বরাদ্দ করা হচ্ছে। সেদিক থেকে বিজ্ঞানশিক্ষা সংকুচিত হওয়ার ভয় নেই। 

শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না দিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম সফলভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে কি আপনি মনে করেন?

হাসিনা খান: এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সবার কাছেই এটি মনে হচ্ছে। এই জায়গাতেই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আমাদের শুরুটা করা দরকার। এ ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা থাকলে আশা করি, এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। সরকারও চেষ্টা করছে। প্রত্যেকেরই যার যার দায়িত্ব পালন করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রমে কিন্তু অভিভাবকদেরও বড় অংশীদার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কারণ, অনেক শিখন অভিজ্ঞতা কিন্তু বাসা থেকেও আসবে। সেভাবেই নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষকের ওপর সম্পূর্ণ দায়িত্ব দিয়ে কাজটি হবে, সেটি এই মুহূর্তেই আশা করছি না। আমরা আশা করছি, এখানে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। এই জায়গাটি একটু চ্যালেঞ্জিং হবে, সেটি বুঝতেই পারছি। আমি আশা করছি, এখানে গণমাধ্যমও একটি গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে এবং দরকারও। কারণ, নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে শিক্ষায় একটি আমূল পরিবর্তন আনবে। বিশেষ করে বিজ্ঞানশিক্ষা আরও আনন্দময় করে তুলবে শিক্ষার্থীদের। 

নতুন শিক্ষাক্রমে ধারাবাহিক মূল্যায়ন অর্থাৎ শিখনকালীন মূল্যায়ন বেশি হবে। কিন্তু বর্তমানে অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে নিয়ম ভেঙে নিজেদের শিক্ষার্থীদের কোচিং-প্রাইভেট পড়ানোর অভিযোগ আছে। 

হাসিনা খান: এটি কঠিন প্রশ্ন। আমি মনে করি, কোচিং-প্রাইভেট বাংলাদেশ থেকে উঠে যাবে না, অন্তত এ মুহূর্তে না। তো আমাদের যেটা দেখতে হবে সেটি হলো, সব নিয়মকানুন মানা হচ্ছে কি না এবং নৈতিকতা ভঙ্গ হচ্ছে না, সেটি আমাদের লক্ষ রাখতে হবে। তবে আমার মনে হয়, নতুন শিক্ষাক্রমে কোচিং-প্রাইভেটের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। সে জন্য শিক্ষকদেরও আন্তরিক হতে হবে। আর শিক্ষকদের আন্তরিক করার জন্য তাঁদের বিদ্যমান বেতনকাঠামো পরিবর্তন করতে হবে এবং তাঁদের সুযোগ–সুবিধা দিতে হবে। আন্তরিক ও টেকসই পরিকল্পনার মাধ্যমেই কাজগুলো হওয়া দরকার। তবে আমার মনে হয়, কোচিং ও প্রাইভেটের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য যে ধরনের শিক্ষাক্রম দরকার, নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে সেটি হবে। 

আরও পড়ুন

শর্ট কোর্সের স্কলারশিপে যুক্তরাষ্ট্রে পড়ার সুযোগ, থাকছে আসা-যাওয়ার খরচ

নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা কমানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী? 

হাসিনা খান: আমাদের দেশে বর্তমানে যেটি আছে, সেটি হলো শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার ভারে ভারাক্রান্ত। নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা কমানোর চেষ্টা হয়েছে। এটিকে আমি সাধুবাদ জানাই। তবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বিষয়ে এখনো বিস্তারিত জানি না। এ বিষয়ে শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করেই সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত হবে বলে আশা করি। 

এর আগে দেখা গেছে, শিক্ষায় অনেক সিদ্ধান্ত হলেও সেগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়িত হয় না। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো, জাতীয় শিক্ষানীতি–২০১০। এ অবস্থায় নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে কতটা আশাবাদী হতে পারি?

হাসিনা খান: শিক্ষা বিষয়ে অন্য একটি কাজ করতে গিয়েও এ ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি। তবে আগে হয়নি বলে এবারও হবে না, এমন ভাবনা আমি বিশ্বাস করতে চাই না। যেকোনো জায়গা থেকে শুরু করতে হবে এবং আশাবাদী হতে হবে। এনসিটিবির সঙ্গে আমার যেটুকু যোগাযোগ, তাতে তাদের আন্তরিক মনে হয়েছে। হয়তো কিছু নৈপুণ্যের অভাব থাকতে পারে। তাদের নানা কাজের চাপ এবং সম্পদেরও সীমাবদ্ধতা আছে বলে বুঝেছি। তাই হয়তো প্রথম বছরেই সর্বোচ্চ ফলাফল পাব না। তবে আশা করছি, সামনের বছরগুলোতে যেসব পরিকল্পনা হবে, তাতে আমি আশাবাদী হতে চাই। এ বিষয়ে সরকারকেও প্রয়োজনীয় সম্পদ ও অর্থের সংস্থান করতে হবে। নতুন শিক্ষাক্রম আধাআধি বাস্তবায়নে ফল আসবে না। একেবারে পুরোপুরি গ্রহণ করতে হবে এবং সামগ্রিকভাবে যা যা প্রয়োজন, সেটির ব্যবস্থা রাখতে হবে। একটি বিষয় পরিকল্পনা করলাম, কিন্তু বাস্তবায়ন করার জন্য ব্যবস্থাগুলো নেব না, তাহলে কিন্তু হবে না। 

সূত্র-প্রথম আলো