ইউক্রেন যুদ্ধ ও এর প্রতি বিশ্বের প্রতিক্রিয়া সামনের দিনগুলোতে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্হা গঠনে ‘গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক’ হিসেবে কাজ করবে। বিশেষ করে, পশ্চিমা মিত্রদের গৃহীত নানা পদক্ষেপ, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠনে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর ভূমিকাসংক্রান্ত পশ্চিমা বিশ্বের পরিকল্পনাই বলে দেবে, পশ্চিমাদের দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত লক্ষ্য আসলে কী।

পশ্চিমারা কি কেবল রাশিয়াকে পরাজিত এবং ন্যাটোকে বিস্তৃত ও শক্তিশালী দেখতে চায়, নাকি ইউক্রেনে এমন একটি ‘বিজয়’ প্রত্যাশা করে—যার হাত ধরে বিশ্বে এমন একটি ভিত্তি স্হাপিত হবে, যেখানে গণতন্ত্র আরো সুরক্ষিত হবে এবং বিশ্বব্যাপী শাসনব্যবস্হা আরো সুসংহত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর হয়ে উঠবে। যদিও চলমান লড়াইয়ের ফলাফল এখনো অনিশ্চিত, তবে পশ্চিমের কৌশলগত লক্ষ্যগুলো, বিশেষ করে ইউক্রেন বিজয়ী হলে রাশিয়ার সঙ্গে কীরূপ আচরণ করা হবে, সেটা ব্যাপক তাত্পর্য বহন করে। এই প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, পশ্চিমারা কি বড়সড় ক্ষতিপূরণ আরোপ করে রাশিয়াকে শাস্তি দিতে চাইবে, নাকি এর পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের স্বৈরাচারী শাসনকে গুঁড়িয়ে দেবে; যা রাশিয়ার জনগণের ওপর চাপানো বোঝাকে হালকা করবে।

যুদ্ধের শুরুতে পশ্চিমা মিত্ররা জোর দিয়ে বলেছিল যে, জাতিসংঘ সনদ (ইউএন চার্টার) এবং গণতন্ত্র রক্ষা করাই তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য। বসন্েতর শেষের দিকে বেশ কিছু মার্কিন কৌশলবিদ ও কর্মকর্তা কৌশলগত লক্ষ্য হিসেবে রাশিয়াকে স্হায়ীভাবে দুর্বল করার পক্ষে সমর্থন দিয়েছিলেন। তবে এটি স্পষ্ট নয় যে, রাশিয়ার শাসনব্যবস্হা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পশ্চিমারা এটিকে এখনো একটি উদ্দেশ্য হিসেবে ধরছেন কি না।

যদিও ইউক্রেন সংঘাতের যে কোনো ধরনের সামগ্রিক নিষ্পত্তির প্রশ্নে রাশিয়াকে যুদ্ধের পুনর্গঠনের বোঝার কিছু অংশ বহন করতেই হবে অবধারিতভাবে, কিন্তু রাশিয়ান জনগণের ওপর আরোপিত শর্তগুলোর তীব্র রাজনৈতিক প্রভাব থেকেই যাবে। শর্তগুলো যত কঠোরতর হবে, রাশিয়ার তরফ থেকে চীনকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে আলিঙ্গন করার সম্ভাবনা তত প্রকট হয়ে উঠবে। যাতে করে একটি শক্তিশালী ‘চীন-রাশিয়ান ব্লক’ যুদ্ধোত্তর ভূরাজনৈতিক ব্যবস্হার অংশ হয়ে উঠতে পারে।

এই জাতীয় জোটের প্রভাবকে খাটো করে দেখা উচিত নয় কোনোক্রমেই। যদিও চীন হবে ব্লকের মাধ্যাকর্ষণ কেন্দ্র, তথাপি রাশিয়ার গুরুত্ব খর্ব হবে না মোটেও। জিডিপি তুনামূলকভাবে ছোট (যা ইতালির চেয়ে কম) হলেও রাশিয়ার বৈজ্ঞানিক সক্ষমতা, পারমাণবিক অস্ত্রাগারের পরিধি, প্রাকৃতিক সম্পদ ও এর বিশাল ভূখণ্ডের কৌশলগত গুরুত্ব চালকের আসনে রাখবে দেশটিকে।

পুতিন ও তার স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্হার বিপরীতে রাশিয়ান জনগণকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার নীতি গ্রহণের মাধ্যমে রাশিয়ার ‘অন্য পথে হাঁটা’ রোধ করার মাধ্যমে বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো একটি দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল আশা করতে পারে; যার ফলে রাশিয়া গণতন্ত্রের পথে হাঁটার সম্ভাবনার রাস্তা থেকে চিরতরে ‘বিস্মৃত’ হয়ে পড়বে না। ভুলে গেলে চলবে না, রাশিয়ানদের ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্র্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে, যেমনটি প্রস্তাব করেছেন কিছু নীতিনির্ধারক, তা দেশটিকে চীনের দিকে ঠেলে দেবে। এর ফলে একটি ভুল পথের আবির্ভাব ঘটবে; বস্ত্তত এরূপ অকার্যকর, অসার, মেরুকরণের রাস্তাই বিশ্বব্যবস্হার মধ্যে বিভক্তির রেখা এঁকে দেয়—গণতন্ত্র এবং স্বৈরাচার। কাজেই মনে রাখতে হবে, পুতিনের মতো একনায়কের সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক নেতা এবং সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে পার্থক্য’ গড়ে তোলার মাধ্যমেই সুফল পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে সফল কূটনৈতিক কৌশলের মূল উপাদান হতে পারে এটিই।

এটা সত্য, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবিলার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করাকে অসম্ভব করে তুলেছে নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়ার ‘ভেটো’ ক্ষমতা। পশ্চিমা মিত্রদের মধ্যে যারা এই বিষয়টি আগেই বুঝতে পেরেছিল, তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করা, এমনকি যুদ্ধোত্তর পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় দেশগুলোকে অন্তভু‌র্ক্ত করার বিষয়ে বেশ কিছু প্রচেষ্টা গ্রহণ করে।

এটাও অবশ্যই সত্য যে, মার্চ মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের দুটি অধিবেশনে রাশিয়ার নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল উন্নয়নশীল বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ। কিন্তু পশ্চিমাদের এটা বোঝা উচিত যে, যুদ্ধের বিপরীতে উন্নয়নশীল দেশগুলো অতীতে যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং দেশগুলোকে যেভাবে এক কাতারে দাঁড়াতে দেখা গেছে তার নেপথ্যে বিশেষ কিছু কারণ আছে। যেমন—ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার তিক্ত সমষ্টিগত স্মৃতি ও স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় এই দেশগুলোকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থন দিয়েছিল।

উপরন্তু, ইউক্রেনের পুনর্গঠনের জন্য একটি প্ল্যাটফরম গড়ে তোলার বিষয়ে জুলাইয়ের শুরুতে পশ্চিমা মিত্র কতৃ‌র্ক আয়োজিত ‘লুগানো সম্মেলন’-এ তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশকেই অন্তভু‌র্ক্ত করা হয়নি। অনেকেই যুক্তি দাঁড় করাতে পারেন যে, এটি প্রাথমিকভাবে দাতাদের একটি সভা ছিল। এক্ষেত্রে বলতে হয়, এই সম্মেলনে বাদ দেওয়া হয় ধনী উপসাগরীয় দেশগুলোকেও। এবং অন্তভু‌র্ক্ত করা হয় আলবেনিয়া ও উত্তর মেসিডোনিয়ার মতো দেশগুলোকে, যারা কেউই অবদান রাখতে সক্ষম হওয়ার মতো নয়।

ইউক্রেন পুনর্গঠনে শত শত বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। কাজেই পুনর্গঠন প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে এইভাবে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর সহায়তা ফিরিয়ে দেওয়ার ফলে ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। ধনী দেশগুলো এখনো তাদের দীর্ঘদিনের প্রতিশ্রুতি পূরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, যাতে করে দরিদ্র দেশগুলোতে জলবায়ু-পরিবর্তন প্রশমন ও অভিযোজনকে ঠিক রাখার জন্য প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদান করা যায়। ইউক্রেনের পুনর্গঠন প্রকল্পগুলোর জন্য ক্রয়ের নিয়মনীতির প্রশ্নে অদাতা উন্নয়নশীল দেশগুলোকেও কার্যকরভাবে প্রতিযোগিতায় রাখা যেতে পারে, যা দেখতেও আকর্ষণীয় হবে বটে।

কিন্তু ইউক্রেনের পুনর্গঠনে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে; বিশেষ করে ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলো, যাদের নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ভালো প্রযুক্তিগত সক্ষমতা রয়েছে, যুক্ত করতে পারলে পশ্চিমাদের জন্য তা বড় সুবিধা এনে দিতে পারে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, এটা করতে পশ্চিমারা খুব বেশি সময় নেবে বলে মনে হয় না। পশ্চিমের উচিত হবে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকেও অন্তভু‌র্ক্ত করা। রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য বাকি নিষেধাজ্ঞাগুলোর বিষয়ে একটি চূড়ান্ত বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে এটি করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে ‘আটকে পড়া’ রুশ অর্থ-সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ করার নিয়ম, বিধি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও।

চলমান যুদ্ধে ইউক্রেন বিজয়ী হলে, রাশিয়ার প্রতি পশ্চিমের আচরণ এবং ইউক্রেনের পুনর্গঠনের সময় উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর প্রতি পশ্চিমা বিশ্বের অবস্হানই নির্ধারণ করবে—অধিকতর অন্তভু‌র্ক্তিমূলক ও ন্যায়সংগত বহুপাক্ষিকতার প্রশ্নে এই যুদ্ধ বৈশ্বিক অগ্রগতির ‘নির্ণয়ক’ হিসেবে কাজ করেছে, নাকি না। পশ্চিমারা একটি ‘পিরিক ভিক্টোরি (অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে অর্জিত মহান বিজয়)’ অর্জন করবে, যা স্বৈরাচারকে শক্তিশালী করবে এবং বিশ্বব্যাপী বিভাজনকে আরো গভীর করে তুলবে। আর সেটি হলে দুঃখজনকভাবে তা হবে খুবই পরিতাপের বিষয়।

কামাল দারভিস

প্রকাশ : ২৭ আগস্ট ২০২২, ০৬:৩৯

লেখক: তুরস্কের অর্থনৈতিক বিষয়ক প্রাক্তন মন্ত্রী, ইউএনডিপির সাবেক অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ও ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো

প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে ভাষান্তর: সুমৃৎ খান সুজন

সুত্র-ইত্তেফাক/