ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিষয়সংক্রান্ত জনসংখ্যা বিভাগের ‘বিশ্ব জনসংখ্যা সম্ভাবনা ২০২২’ অনুযায়ী সর্বশেষ জনসংখ্যার প্রক্ষেপণ বলছে ১৫ নভেম্বর ২০২২, বিশ্বের জনসংখ্যা পৌঁছে যাবে ৮০০ কোটি বা ৮ বিলিয়নে। ১৮০৪ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল এক বিলিয়ন। ১৯২৭ সালে হয় দুই বিলিয়ন। ১৯৭৪ সালে বিশ্ব জনসংখ্যা পৌঁছে যায় চার বিলিয়নে। আর বর্তমানের আট বিলিয়ন আগামী ২০৩৭ সালে পৌঁছে যাবে নয় বিলিয়নে এবং ২০৫৮ সালে ১০ বিলিয়নে। বর্তমানের আট বিলিয়ন জনসংখ্যা নিয়ে যদি বলি তবে বলতে হবে নিঃসন্দেহে এটি একটি মাইলফলক। একদিকে চ্যালেঞ্জ আরেক দিকে সম্ভাবনার। আগে আমাদের এ বিশ্ব কখনো আট বিলিয়ন জনসংখ্যায় পৌঁছেনি। আট বিলিয়ন জনসংখ্যা মানে আট বিলিয়ন শক্তি, বড় সংখ্যা, বড় চ্যালেঞ্জ ও বড় সম্ভাবনা।

কেমন করে আমাদের এ বিশ্ব জনসংখ্যার এ আকারে এসে পৌঁছল? তা বোঝা যায় ডেমোগ্রাফিক ট্রাঞ্জিশন মডেল অনুসরণে উচ্চজন্ম ও মৃত্যুহার থেকে নিম্ন জন্ম ও মৃত্যুহারে ধাবিত হওয়া অনুযায়ী। ৮০০ কোটির এ বিশ্বে কী বার্তা রয়েছে আমাদের জন্য? কী বার্তা রয়েছে বাংলাদেশের জন্য? বিশ্বের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যাচ্ছে, বিশ্ব জনসংখ্যার আকার অব্যাহতভাবে বাড়ছে তবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে কমে এসেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি মূলত দরিদ্র দেশগুলোতেই লক্ষণীয়। ২০২২-৫০ সালের মধ্যে ৬৫ বছরের নিচের জনগোষ্ঠী মূলত দরিদ্র ও নিম্ন মধ্য আয়ের দেশগুলোতেই বাড়ছে আর উচ্চ আয় ও উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশগুলোয় ৬৫ বছরের ঊর্ধ্ব জনগোষ্ঠী বাড়তে থাকবে। সম্পদশালী দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিম্ন আয়ের ও নিম্ন মধ্য আয়ের দেশগুলোকে টেকসই উন্নয়নে জনসংখ্যার গুণগত উন্নয়নে কারিগরি ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা উচিত। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে জনবহুল দেশ হলো চীন (১৪২৬ মিলিয়ন), ভারত (১৪১২ মিলিয়ন), যুক্তরাষ্ট্র (৩৩৭ মিলিয়ন), ইন্দোনেশিয়া (২৭৫ মিলিয়ন), পাকিস্তান (২৩৪ মিলিয়ন), নাইজেরিয়া (২১৬ মিলিয়ন), ব্রাজিল (২১৫ মিলিয়ন), বাংলাদেশ (১৭১ মিলিয়ন)। বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের অষ্টম (১৭১ মিলিয়ন) জনবহুল দেশ হলেও ২০৫০ সালে বিশ্বে অবস্থান হবে দশম (২০৪ মিলিয়ন)। বিশ্ব জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ২ দশমিক ২ শতাংশ জনগোষ্ঠী। জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ বলছে, ২০৩০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ১৮৪ মিলিয়নে, আর ২০৪১ সালে ১৯৭ মিলিয়নে। অতীতের অভিজ্ঞতা, বর্তমান বাস্তবতায় ও ভবিষ্যৎ বিবেচনায় আট বিলিয়নের এ বিশ্বে ১৭১ মিলিয়ন জনসংখ্যার বাংলাদেশের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা নিয়ে এসেছে যা নীতিনির্ধারকসহ সবার জন্যই প্রযোজ্য।

আরও পড়ুন

দক্ষিণ কোরিয়া: যেভাবে এই দেশটি বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের এক নম্বর পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠেছে
বাংলাদেশের জনসংখ্যার আকার ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে, কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমছে। বিশ্ব জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ২ দশমিক ২ শতাংশ জনগোষ্ঠী। অনুপাত ও সংখ্যার বিচারে এটি মোটেও কম নয়। বিশ্বের অষ্টম জনবহুল এদেশের জনঘনত্ব বিশ্বে অন্যতম সর্বাধিক যেখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বর্তমানে বাস করে ১ হাজার ৩১৫ জনেরও বেশি, যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ফলে পরিকল্পনায় জনঘনত্ব বিবেচনায় নিয়ে কর্মকৌশল নিতে হবে। নীতি-কৌশল বিশেষ করে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত পরিবার পরিকল্পনার কর্মসূচির কারণে মোট প্রজনন হার হ্রাস পাওয়ায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমায় তাত্পর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দেশের মানুষের জীবন আয়ুষ্কাল বেড়েছে। বাংলাদেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক বৃদ্ধির হার বাড়ছে, যা মাথাপিছু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হতে পারে। প্রথম জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের সুযোগ বাংলাদেশের জন্য ২০৩৬-৩৭ পর্যন্ত অনুকূলে থাকবে। পাশাপাশি বাংলাদেশে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ও আনুপাতিক আকার বাড়ছে। ২০৩০ সালে ৬৫ বছর ও তার ঊর্ধ্বে বয়স্ক জনগোষ্ঠী হবে প্রায় ৮ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে তা পৌঁছে যাবে সাড়ে ১১ শতাংশের বেশি। বয়স্ক জনগোষ্ঠীর চাহিদা ও সেবা নিশ্চিত করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। নগর জীবনে উদ্ভূত হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। জলবায়ুর পরিবর্তন বা পরিবেশগত (প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন, বন্যাসহ) বিভিন্ন কারণে শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছে মানুষ। জনসংখ্যার গতিধারায় আন্তর্জাতিক স্থানান্তরের একটি প্রভাবও লক্ষ করা যাচ্ছে। ‘বিশ্ব জনসংখ্যা সম্ভাবনা ২০২২’ অনুযায়ী ২০১০-২১ সময়কালীন বিশ্বব্যাপী ২ দশমিক ৯ মিলিয়ন বাংলাদেশ থেকে আন্তর্জাতিক অভিবাসী হিসেবে মূলত কাজের জন্য বাইরের গিয়েছে। আর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ অধিকতর সুরক্ষাহীন যার প্রভাব জনমিতিক গতিশীলতায় লক্ষণীয়। প্রাকৃতিক কারণে বাস্তুচ্যুত দেশীয় জনগোষ্ঠীর বাইরে প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক ১০ লক্ষাধিক বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী রয়েছে। এ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে জন্ম নিরোধক পদ্ধতি ব্যবহারের কম ও প্রজনন হার বেশি, যেদিকে সতর্ক দৃষ্টির প্রয়োজন। শেষ বার্তা হলো উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনসংখ্যার সঠিক, আপডেটেড, নিয়মিত অসমগ্রীভূত বা অসমষ্টিভূত উপাত্তের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ২০১১-পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালে জনশুমারি ও গৃহগণনা সম্পাদন করা হলেও এখনো শুমারি-উত্তর যাচাই শেষে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন চূড়ান্ত করা হয়নি। জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনায় জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায়ের উপাত্তের বিশ্লেষণে জনসংখ্যার বয়স, লিঙ্গ ও ভৌগোলিক অবস্থানগত তথ্য নীতিনির্ধারণে ও টেকসই উন্নয়ন পথে অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে। আট বিলিয়নের জনসংখ্যার এ বিশ্বে সবার জন্য সহনশীল ভবিষ্যৎ, সুযোগকে কাজে লাগানো এবং অধিকার ও পছন্দ নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে জনসংখ্যা বাড়ানো বা কমানো নয় বরং সবার সুযোগ গ্রহণে সমান প্রবেশগম্যতা ও সুযোগকে কাজে লাগাতে প্রতিবন্ধকতা দূর করা- প্রান্তিক বা পিছিয়ে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা। সবার মানবাধিকার ব্যক্তির প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার ও পছন্দকে গুরুত্ব প্রদান।
১৯৯৪ সালে মিসরের কায়রোয় অনুষ্ঠিত যুগান্তকারী জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক আন্তর্জাতিক সন্মেলনে সবার মানবাধিকার, ব্যক্তির প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার ও পছন্দকে গুরুত্ব প্রদান। জনসংখ্যা ও উন্নয়নবিষয়ক এ যুগান্তকারী এ সন্মেলনের ২৫ বছর পূর্তিতে ২০১৯ সালের নভেম্বরে নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সন্মেলন প্রদানকৃত পুনঃপ্রতিশ্রুতিগুলো ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনকালের মধ্যেই তিন শূন্য লক্ষ্যমাত্রা (প্রথমটি, শূন্য মাতৃ মৃত্যুহারে নিয়ে যাওয়া, দ্বিতীয় পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদা শূন্যতে নিয়ে আসা এবং তৃতীয়ত যৌন ও জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতন দূরীকরণ ও বাল্যবিবাহ শূন্যতে নিয়ে আসা) বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে যদিও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার উন্নয়নে রয়েছে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। করোনা মহামারী পূর্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়বৃদ্ধি, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, পাঁচ-বছরের নিচে বয়সীদের ক্ষেত্রে শিশুমৃত্যুর হার, মোট প্রজনন হার হ্রাস, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার বৃদ্ধি ও জীবন আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পেলেও এসব অগ্রগতির পাশাপাশি মহামারী-উত্তর নতুন ও উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ কিংবা অসম উন্নয়নও লক্ষণীয়। যুবগোষ্ঠী ও দ্রুত বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়ছে। এখানে বেকারত্বের হারে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি, বরং বেড়েছে। আয় বৈষম্যেও আসেনি কোনো উন্নতি হয়নি। দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। নগর জীবনে উদ্ভূত হচ্ছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। জলবায়ুর পরিবর্তন বা পরিবেশগত (প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নদীভাঙন, বন্যাসহ) বিভিন্ন কারণে শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছে মানুষ।
বর্তমানে বাংলাদেশে নারী, কিশোর-কিশোরী ও যুবগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে পরিবার পরিকল্পনা এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশে ২০-২৪ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের মধ্যে বাল্যবিবাহের হার ৫৯ শতাংশ (বিডিএইচএস ২০১৭-১৮)। কিশোরী অবস্থায় গর্ভধারণের হার অনেক বেশি (২৭ দশমিক ৮ শতাংশ-বিডিএইচএস ২০১৭-১৮)। ২০১১ ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮ ও মাল্টিপল ক্লাস্টার ইন্ডিকেটর সার্ভে ২০১৯-এর তথ্যানুযায়ী সমগ্র প্রজনন হার হ্রাসে হয়নি কোনো অগ্রগতি (২ দশমিক ৩-এ স্থিতাবস্থায় রয়েছে)। বিভাগীয় কিংবা অঞ্চলভেদে রয়েছে বেশ পার্থক্য সিলেট ও চট্টগামে এ হার বেশি। জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ব্যবহারের হারেও নেই অগ্রগতি (৬২ শতাংশ, বিডিএইচএস ২০১৭-১৮)। ১৫-৪৯ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদার হার ১২ শতাংশ হলেও ১৫-১৯ বছর বয়সীদের মধ্যে তা বেশি (১৫ দশমিক ৫ শতাংশ, বিডিএইচএস ২০১৭-১৮)। সিলেট, চট্টগাম ও বরিশালে এ হার অনেক বেশি। ‘জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ২০১২’ অনুযায়ী এ-সংক্রান্ত নীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নির্ধারিত সময় অনুযায়ী যায়নি। এখনো বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যু হার অনেক বেশি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রতি এক লাখ জীবিত জন্মে ৭০-এর হ্রাস করা বাংলাদেশের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। সে সঙ্গে এখন বাংলাদেশে মানুষের মৃত্যুর প্রধান কারণ অসংক্রামক ব্যাধি এবং ক্রমান্বয়ে তা বাড়ছেই। এখানে অসংক্রামক ও সংক্রামক রোগের দ্বৈত বোঝা বিদ্যমান। জনসংখ্যার বয়স কাঠামোয় আশাব্যঞ্জক পরিবর্তনে জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনের সুযোগ থাকলেও তা নির্ভর করছে সৃষ্ট এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করার। কর্মক্ষম এ জনগোষ্ঠীর সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক নীতি ও সুশাসন নিশ্চিতকরণের ওপর। দেশে এখন প্রতি বছর ২ দশমিক ১ মিলিয়ন কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী জনসংখ্যায় যোগ হচ্ছে। বিবিএসের সর্বশেষ শ্রম জরিপ ২০১৬-১৭-এর প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ১৫-২৯ বছর বয়সী যুবগোষ্ঠীর ২৯ শতাংশই শিক্ষা, চাকরি অথবা প্রশিক্ষণের কোনোটিতেই নেই, যেখানে নারীরা অধিকতর সুরক্ষাহীন। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে এখনো মোট বাজেটের বরাদ্দ ইউনেস্কো ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়া হয় না। জনমিতিক লভ্যাংশ অর্জনে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক প্রসারে অধিকতর গুরুত্ব ও বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ হয়নি। জাতীয় পরিকল্পনায় জনসংখ্যার বিষয়টি অধিকতর গুরুত্বের দাবি রাখলেও জাতীয় জনসংখ্যা নীতির বাস্তবায়নে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে থাকা ‘জাতীয় জনসংখ্যা পরিষদ’ এনপিসি একেবারেই নিষ্ক্রিয় বলা যায়। গত এক দশকেওএ পরিষদের হয়নি কোনো সভা। বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে সঠিক চিত্র তুলে ধরতে ও কর্মকৌশল নির্ধারণে যথাযথ ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে এ কমিটির পুনর্গঠন ও তা কার্যকর দরকার বলে মনে করি। বর্তমানে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো বাল্যবিবাহ, কিশোরী মাতৃত্ব, শ্রমবাজারে নারীর কম অংশগ্রহণ, কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় স্থানীয় ও পরিবর্তিত বিশ্ববাজারে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া। শুধু বাল্যবিবাহের কারণেই অর্ধেকের বেশি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা হবে আমাদের জন্য দুরূহ। বাল্যবিবাহ নিরোধ ছাড়াও আমাদের দরকার পরিবার পরিকল্পনা, প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার নিশ্চিতকরণ এবং নারীর ক্ষমতায়নের ওপর গুরুত্ব প্রদান। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে জনসংখ্যা ও উন্নয়ন ইস্যুগুলোকে জাতীয় নীতি এবং পরিকল্পনায় সমন্বয় ও একীকরণ দরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে।
পরিশেষে বাংলাদেশের ১৭১ মিলিয়নের বেশি জনসংখ্যাকে ১৭১ মিলিয়নের বেশি সম্ভাবনায় রূপান্তর করতে হলে আমাদের দরকার জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, শিক্ষার বিস্তার ও সুরক্ষাহীন জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন, রাজনৈতিক কমিটমেন্ট এবং বাস্তবায়ন। জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা মানব পুঁজি হতে হলে করতে হবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ। জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে অধিকার ও পছন্দের ভিত্তিতে সম্ভাবনা ও সুযোগের প্রেক্ষাপটে জনসংখ্যার সঠিক আকার ও বণ্টন (যেমন—বয়স, লিঙ্গ, অঞ্চল, ধর্ম, নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, কর্ম) জানা জরুরি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী দেশের জনসংখ্যার আকার, কাঠামো, বণ্টন, বৃদ্ধি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানব জনসংখ্যাকে সাসটেইনেবল বা বজায়যোগ্য আকারে রাখার চর্চা অব্যাহত রাখা। জনসংখ্যার সঙ্গে অধিকতর সম্পর্কিত জাতীয় অনেক নীতিরই (যেমন—জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ২০১২, জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩) দরকার হালনাগাদ করা, বিশেষ করে টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা-এসডিজিকে লক্ষ্য করে। আমাদের দরকার জনসংখ্যাকে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে জনসংখ্যার গতিময়তাকে অনুধাবন এবং সে অনুযায়ী চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে কর্ম-উদ্যোগ গ্রহণ করা, গুণগত উন্নয়নকে অগ্রাধিকার প্রদান। এক্ষেত্রে জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় একদিকে মৌলিক অধিকার রক্ষা করা, অন্যদিকে মানুষের মঙ্গলে গুণগত সেবা নিশ্চিত করা। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যবস্থাপনায় ভূমি ও সম্পদ এবং দক্ষ সেবা প্রদানের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, পুষ্টি, শ্রমবাজার, আয়ের সুযোগ এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন সাধন করা। ৮০০ কোটির বিশ্বে ১৭১ মিলিয়নের বাংলাদেশে মূল দৃষ্টি হবে—জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনায় বৃদ্ধি, ঘনত্ব, জেন্ডার-সমতা, বণ্টন ব্যবস্থা ও গতিশীলতায়।
ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম: অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সূত্র-বণিক বার্তা

আরও পড়ুন

অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় হাতিয়ার হলো শিক্ষা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের ‘পাঠে কেন মন বসে না’

খাদ্যে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায় ক্ষতিকর ধাতব