বণিকবার্তা এ প্রকাশিত ১২-০১-২০২০

ড. মোস্তফা কে. মুজেরি

বাংলাদেশের মতো দেশে যদিও গতানুগতিকভাবে বিপুল জনসংখ্যাকে জোরালো প্রবৃদ্ধির প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু সাম্প্রতিক উন্নয়ন ধারায় জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মধ্যে দুই ধরনের ইতিবাচক মিথস্ক্রিয়ার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়; বিশেষত জনসংখ্যার পরিবর্তনশীল বয়স কাঠামোর দিক থেকে। বয়স কাঠামোয় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবীভাবে নির্ভরশীলতা অনুপাত কমায়, যা উচ্চতর প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে; যদি শ্রমশক্তির কর্ম নিয়োজন সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সমর্থনমূলক বা পৃষ্ঠপোষকতামূলক নীতি সমর্থন দেয়া সম্ভব হয়।

নির্ভরশীলতা অনুপাতের প্রাথমিক হ্রাস শুরু হয় উচ্চ থেকে নিম্ন জন্মহারে জনমিতিক রূপান্তর এবং মৃত্যুহার হ্রাসের মাধ্যমে, যা অর্থনীতির জন্য জনমিতিক লভ্যাংশের সুফল নিশ্চিত করে এবং এই জনমিতিক সুবিধা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর অংশ শীর্ষে না পৌঁছা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। তার পর থেকে বয়স বৃদ্ধির কারণে নির্ভরশীলতা অনুপাত বৃদ্ধি শুরু হয়। কেননা তখন থেকে ৬৫ বছরের অধিক বয়সী মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান থাকে; যা বয়সজনিত নির্ভরশীলতা বাড়ায়। জনসংখ্যা গতিশীলতার এই ধাপে একটি দ্বিতীয় জনমিতিক লভ্যাংশের সুবিধা লাভ করা সম্ভব, যদি উচ্চ আয়ের মাত্রা বজায় রাখা যায় এবং মানুষ নিজেদের অবসরোত্তর জীবনের জন্য পর্যাপ্ত সঞ্চয় ও সম্পদ পুঞ্জীভূত করতে পারে। অবশ্য জনমিতিক গতিশীলতার এসব সুফল কেবল তখনই বাস্তবায়ন সম্ভব, যখন মানবপুঁজি বা সম্পদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা পালন করে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে কীভাবে নির্ভরশীলতা অনুপাত পরিবর্তন হয়েছে, তা দেখা যেতে পারে। ১৯৫০ ও ২০১০ সালের মধ্যে ৮২ দশমিক ৩ থেকে ৫৮ দশমিক ৩ শতাংশ কমে মোট নির্ভরশীলতা অনুপাত কমেছে ২৪ শতাংশীয় পয়েন্ট। সেটি পুরোপুরিভাবে শিশু নির্ভরশীলতা অনুপাত (যা কমেছিল ২৪ দশমিক ৪ শতাংশীয় পয়েন্ট) হ্রাসের কারণে। অন্যদিকে আলোচ্য সময় পর্বে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর নির্ভরশীলতা অনুপাত সামান্য বেড়েছিল। এটি দেখায় যে বাংলাদেশ বর্তমানে একটি জনমিতিক লভ্যাংশের সময় অতিক্রম করছে।

বর্তমান প্রাক্কলন থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে অব্যাহতভাবে শিশু নির্ভরশীলতা অনুপাত কমবে এবং বয়স্ক জনগোষ্ঠীর নির্ভরশীলতা বাড়বে। তথ্যানুযায়ী, শিশু নির্ভরশীলতা অনুপাত যেখানে ২০১০ সালের ৫০ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২০৫০ সালে ২৫ দশমিক ৬ শতাংশে কমে আসবে, যেখানে বয়স্ক জনগোষ্ঠীর অনুপাত ২০১০ সালের ৭ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০৫০ সালে ২৩ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হবে।

কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে ১৯৫০ সালে ১৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন (মোট জনসংখ্যার ৫৪ দশমিক ৮ শতাংশ) থেকে বেড়ে ২০১০ সালে ৮৩ দশমিক ৫ মিলিয়নে (মোট জনসংখ্যা ৬৩ দশমিক ২ শতাংশ) উন্নীত হয়েছে। প্রাক্কলন করা হচ্ছে, ২০৪০ সালে তা ১৩৭ মিলিয়নে (৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ) পৌঁছবে।

উল্লিখিত তথ্য এটি দেখায় যে ২০১০ ও ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের শ্রমশক্তির আয়তন প্রায় ৫৩ মিলিয়ন বাড়বে, আজকের তরুণ জনগোষ্ঠী মানবপুঁজি উন্নয়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে বাংলাদেশকে নানা ধরনের সুবিধা দেবে, যারা দুই দশকের মধ্যে শ্রমশক্তিতে যোগ দেবে।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতি কী হওয়া উচিত, তা অত্যন্ত পরিষ্কার। বাংলাদেশকে অবশ্যই তার জনসংখ্যা মধ্য একুশ শতকে পৌঁছার আগে উচ্চশ্রম দক্ষতাসম্পন্ন জনশক্তি সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে; যাতে বাংলাদেশ পরবর্তী সময়ে অর্থনীতিতে নতুন আবির্ভূত সমস্যা মোকাবেলা করতে পারে এবং সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারে।

সন্দেহ নেই, কর্মসংস্থান সৃষ্টি আজকের বাংলাদেশে নীতিনির্ধারকদের প্রধান উদ্বেগ। বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি মাসে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বাড়বে ১ লাখ ৭০ হাজার এবং কর্মসংস্থানের বিদ্যমান হার ধরে রাখতে প্রতি বছর ১ দশমিক ১ মিলিয়ন অতিরিক্ত কর্মসংস্থান প্রয়োজন হবে। ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায়, শ্রমশক্তির মোট সংখ্যা ২০১০ সালে ৫৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন থেকে ২০১৭ সালে ৬৩ দশমিক ৬ মিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। বলা যায়, সাত বছরে ৬ দশমিক ৯ মিলিয়ন কিংবা প্রতি বছর প্রায় এক মিলিয়ন বেড়েছে।

শ্রমবাজারে অনানুষ্ঠানিকতা হলো প্রধান বৈশিষ্ট্য। ২০১০ সালে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০১৭ সালে ৮৫ দশমিক ১ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান সংঘটন সামান্য কমেছে বটে, কিন্তু শ্রমবাজারে এখনো অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের আধিপত্য বেশি।

নীতি প্রেক্ষিত থেকে আমাদের শ্রমবাজারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আলাদা করা প্রয়োজন। স্বল্পমেয়াদে প্রবৃদ্ধি বেশি শ্রম চাহিদার সঙ্গে কর্মসংস্থান হার বাড়াতে পারে। অন্যদিকে আয় ও জীবনমান বৃদ্ধি এবং শ্রমশক্তিতে প্রবেশের আগে পরিবারগুলোর নিজেদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষায় বেশিদিন রাখার সামর্থ্য বৃদ্ধির কারণে দীর্ঘমেয়াদে কর্মসংস্থান হার কমতে পারে। শ্রমবাজারের বৈশিষ্ট্য এবং প্রাপ্ত তথ্য নির্দেশ করে যে বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্পর্ক কিছুটা হলেও দুর্বল।

বিভিন্ন মাত্রার মাথাপিছু আয়ের দেশগুলোয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের ওপর প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ একটি ইউ আকারের রেখার ইঙ্গিত দেয়। নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় খুব উচ্চ কর্মসংস্থান হার বজায় থাকে, যেখানে নারী-পুরুষ উভয়ই অল্প বয়সে কাজ করা শুরু করে এবং যেখানে বেকার কিংবা শেষ জীবনে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আর্থিক সংস্থান করা যায় না।

গবেষণায় দেখা যায়, মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশে কর্মসংস্থান হার অনুমিত মাত্রার চেয়ে নিচে। এটি এজন্য যে অন্য দেশগুলোর তুলনায় নারীদের অর্থকড়ি কাজে অংশগ্রহণ কম। বাংলাদেশে পুরুষ ও নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণে ব্যাপক ব্যবধান বিরাজমান। ২০১০ সালে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণ হার ছিল যথাক্রমে ৮২ দশমিক ৫ ও ৩৬ শতাংশ। ২০১৭ সালে তা সামান্য পরিবর্তন হয়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৮০ দশমিক ৫ ও ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশে।

অনানুষ্ঠানিক খাতে ৮৫ শতাংশ শ্রমশক্তি থাকার বিষয়টি নীতি প্রণয়নে আনতে হবে। এক্ষেত্রে প্রাধিকারের বিষয়গুলো হলো: এ বিপুলসংখ্যক শ্রমশক্তির কীভাবে শোভন কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা যায় এবং তাদের বর্তমান চাকরি পদমর্যাদার মধ্যে তাদের আয় কীভাবে বাড়ানো যায়, যদি তাদের সেখানে থাকা ছাড়া আর কোনো সুযোগ না থাকে।

এক বাজার বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায়, স্বল্পমেয়াদে কর্মসংস্থান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সাড়া দেয়। এর অর্থ বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থানহীন নয়। এতে আরো দেখা যায়, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে তাত্পর্যপূর্ণসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তবে অধিকাংশ কর্মসংস্থানই নিম্ন দক্ষতানিবিড়, নিম্নমজুরির এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে হওয়ায় সৃষ্ট কর্মসংস্থানের প্রকৃতি সন্তোষজনক নয়। এটি একটি বিষয় প্রমাণ করে যে অধিক ও ভালো কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে জোরালো প্রবৃদ্ধি এককভাবে যথেষ্ট নয়। কাজেই মানসম্পন্ন ও শোভন কর্মসংস্থান বাড়াতে পারে এমন নীতিগুলোয় জোর দিতে হবে। অধিকন্তু প্রবৃদ্ধির কর্মসংস্থান স্থিতিস্থাপকতায় সম্ভবত অব্যাহত হ্রাস ঘটছে, এটিও ব্যাপক নীতি মনোযোগ দাবি করে।

বর্তমানে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্পর্কিত প্রধান চ্যালেঞ্জ দুটি। এক. কর্ম নিয়োজন সক্ষমতা ঘাটতি এবং দুই. অসমতা। এ দুটি বিষয় তাত্পর্যজনকভাবে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ উন্নয়ন সম্ভাবনা এবং এর উচ্চতর প্রবৃদ্ধি বাঁকবদলের উত্তরণ ব্যাহত করবে। এসব চ্যালেঞ্জের স্বল্পমেয়াদি সাড়া হিসেবে প্রয়োজন মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান ও শ্রমশক্তির আত্মকর্মসংস্থানের জন্য আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক ভোকেশনাল, কারিগরি ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। আর মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে দরকার প্রাক-শৈশবকালীন শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ জোর দিয়ে দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যথাযথ অভিযোজন। মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে উত্তরণে যা বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, জনমিতিক লভ্যাংশের সুফল কার্যকরভাবে নিশ্চিতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা।

যদিও প্রাথমিকের সঙ্গে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণে সরকার জোর দিয়েছে, এখন শিক্ষার গুণ ও সমতা উন্নয়নেও নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে ব্যাপকভিত্তিক উপাদানসমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ শ্রমশক্তির পুরো জীবনচক্র সমন্বয় করে একটি সফল দক্ষতা উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখার নমনীয় স্কিল উন্নয়ন, যা প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে শুরু করা দরকার। এর জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও শিশু স্বাস্থ্য উদ্যোগ—প্রাক-শৈশব উন্নয়নের দুটি প্রধান স্তম্ভ—এ দুটির মধ্যে নিবিড় সমন্বয় জরুরি।

ড. মোস্তফা কে. মুজেরি: নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম) ও সাবেক মহাপরিচালক, বিআইডিএস

Source: The report originally published in bonikbarta.net dated 12.01.2020.

DISCLAIMER : Views expressed above are the author's own. The contents provided here are only for educational assistance & information purposes only. Information is provided without warranty and is to be used at the risk of the reader. All trademarks, logos and copyright issues are property of their respective owners. The creator of this page takes no responsibility for the way you use the information provided on this site.