শুক্রবার সকাল থেকে জাপানের কানসাই অঞ্চলে মেঘচ্ছন্ন ছিল। আর এই অঞ্চলের নারা শহরে আগামী ১০ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য জাপানের উচ্চকক্ষের ভোটের প্রচারণায় অংশ নিতে এসেছিলেন, জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘতম ক্ষমতায় থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে।

সকালে মন্দিরের এই শহরে স্থানীয় এক রেলস্টেশনের পাশেই নির্বাচনি ভাষণের সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন শিনজো আবে। আর তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জাপানের ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় অধ্যায়ের জন্ম হল। প্রকৃতির মেঘাচ্ছনের মত জাপানিদের মনও কালো মেঘে ঢেকে গেল।

সকালে সাড়ে ১১ টায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সন্ধ্যা ৬ টায় সরকারিভাবে শিনজো আবের মৃত্যুর ঘোষণার আগ পর্যন্ত জাপানিরা ছিল উৎকণ্ঠিত। কিন্তু ফিরে আসার প্রার্থনা ও সব প্রত্যাশাকে ফেলে অন্যদেশের যাত্রী হয়ে গেলেন ৬৮ বছর বয়সী এই নেতা।

১৯৫৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানী টোকিওতে জন্ম নেওয়া শিনজো আবেকে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর জাপানের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে বড় প্রভাবশালী নেতা মনে করা হয়। বলা হচ্ছে, গত দেড় দশকের জাপানের অর্থনৈতিক ও আন্তজ়াতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে এই নেতার ভূমিকাকে সামনে রাখা হয়।

আবের পরিবার আগে থেকেই জাপানের রাজনীতিতে বেশ প্রভাবশালী। তাঁর বাবা একসময় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। নানা নবোসুকে কিশি ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ছিলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর পরিবারের আরও একজন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক করা শিনজো আবে বাবার মৃত্যুর পর আবে ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো এলডিপির টিকিটে এমপি নির্বাচিত হন। কয়েক দশক আগে পিয়ংইয়ংয়ের হাতে জাপানি নাগরিক অপহরণের ঘটনা নিয়ে প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে শক্ত অবস্থান তাকে দেশজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী জাপানে সবচেয়ে কম বয়সে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছিলেন আবে, ২০০৬ সালে।তবে ২০০৭ সালেই বিতর্কের মুখে পড়েন তিনি। তাঁর সরকার জনগণের পেনশন রেকর্ড হারিয়ে ফেললে প্রায় পাঁচ কোটি জাপানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন তিনি। তারপর ২০১২ সালে আবারও প্রধানমন্ত্রী পদে ফিরে আসেন শিনজো আবে। এরপর একাধারে জিতেছেন ২০১৪ ও ২০১৭ সালের নির্বাচন। দায়িত্ব পালন করেন ২০২০ সাল পর্যন্ত। এই সময়ে তার জনপ্রিয়তা ওঠানামা করেছে, কিন্তু সবসময়ই তিনি ছিলেন চ্যালেঞ্জহীন।

 ২০১২ সালে ফের ক্ষমতায় ফিরে জাপানের অর্থনীতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও সামরিক শক্তি বাড়ানোয় মনোযোগ দেন তিনি।প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রের বেলায় শিনজো আবে আগ্রাসী নীতির সমর্থক ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সংবিধানও বদলানোর চেষ্টা করেছেন। কারণ তিনি জানতেন, যুক্তরাষ্ট্রের খসড়া করা ওই সংবিধান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি বাহিনীর লজ্জাজনক পরাজয়ের অন্যতম স্মারক। তাঁর আমলেই জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথম দেশের বাইরে যুদ্ধ করার এবং মিত্র কোনো দেশ আক্রমণের শিকার হলে তাঁদের সুরক্ষায় সেনা পাঠানোর বিষয়টি অনুমোদন করে।

তবে সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুচ্ছেদ বদলে জাপানের সেলফ ডিফেন্স ফোর্সকে আক্রমণাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করার মাধ্যমে একটি পরিপূর্ণ সেনাবাহিনীতে রূপান্তরে তাঁর যে দীর্ঘদিনের ইচ্ছা তা পূরণে তিনি ব্যর্থ হন।

২০২০ সালে স্বাস্থ্যগত কারণে পদত্যাগ করার পরও ছিলেন রাজনীতিতে সক্রিয়। দেশটির ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সবচেয়ে বড় অংশও মূলত তাঁরই নিয়ন্ত্রণে ছিল।

দ্বিতীয় মেয়াদে আবে যখন দায়িত্ব শুরু করেন জাপানে তখন অর্থনৈতিক মন্দা। তাঁর গৃহীত কাঠামোগত সংস্কার, মুদ্রা ব্যবস্থার সহজীকরণ, আর্থিক প্রণোদনা ও অর্থনৈতিক নীতির কারণে খুব সহজেই সচল হয়ে ওঠে জাপানের অর্থনীতি।

২০১৩ সালে আবে জাপানের সংসদে এক ঘোষণাতে বলেন যে জাপানের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জিবীত করা ও ইয়েনের মানের অবনতি ঠেকানো জাপানের জন্য "সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী বিষয়।"  তার দেয়া অর্থনৈতিক কৌশল ইংরেজিতে অ্যাবেনমিকস (Abenomics) নামে পরিচিতি পেয়েছে। এটি তিনটি "তীর" নিয়ে তৈরি একটি নীতি। প্রথম তীর হল ২% মুদ্রাস্ফীতি অর্জন, দ্বিতীয়টি হল সংক্ষিপ্ত মেয়াদের জন্য অর্থনীতিকে চাঙা করার জন্য এবং পরবর্তীতে বাজেটে উদ্বৃত্ত অর্জনের জন্য একটি পরিবর্তনীয় আর্থিক নীতি এবং তৃতীয়টি হল দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধির জন্য বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ ও কাঠামোগত সংস্কার।

 

কয়েক দশক ধরে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানোর সাহসী পদক্ষেপ নেন আবে। ইন্দো–প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক শক্তি জোরদারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় কৌশলগত সামরিক জোট কোয়াড গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন জাপানের এই প্রধানমন্ত্রী।

আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারানো আবের এই প্রস্থান মেনে নেওয়ার মতো নয়। বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব শিনজো আবের প্রস্থান কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর মতো নক্ষত্রের ছোঁয়ায় জাপানের যে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছিল, তা থেমে যাবে না গতিশীল থাকবে তা সময় বলে দেবে। তবে আপাতত দৃষ্টিতে শিনজো আবের এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যু জাপানের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলবে। শান্তিপ্রিয় জাতির তিলকে কলঙ্কমোচনে দায়ভার জাপানিদের উপর এলো।

ঘাতকের বুলেটে শিনজো আবে হয়তো মহাশূন্য হারিয়ে গেছেন, তবে তাঁর ফেলে যাওয়া কর্ম তাঁকে বেঁচে রাখবে, জাপানিদের হৃদয়ে, বিশ্ববাসীর হৃদয়ে।