ভারতে প্রথমবারের মতো ‍আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে ১৫তম রাষ্ট্রপতি  নির্বাচিত হয়েছেন দেশটির ক্ষমতাসীন এনডিএ জোটের প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মু। তিনিই দেশটির প্রথম কোনো আদিবাসী নারী, যিনি রাইসিনা হিলসের মসনদে বসলেন ।বর্তমানে তার বয়স ৬৪ বছর। বয়স দিয়েও তিনি দুটি নতুন রেকর্ড গড়েছেন।তিনিই এখন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি। ভারতের স্বাধীনতার পর জন্ম নেওয়া কেউ এই প্রথম দেশটির সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।

সরকারি অফিসের কেরানি, স্কুলশিক্ষিকা, কাউন্সিলর, বিধায়ক, মন্ত্রী, রাজ্যপাল থেকে ভারতের সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু 1958 সালের 20 জুন ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জ জেলার বাইদাপোসি গ্রামে একটি আদিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বিরাঞ্চি নারায়ণ টুডু এবং দ্রৌপদী মুর্মু সাঁওতাল উপজাতি পরিবারের অন্তর্গত।সাঁওতাল সম্প্রদায়ের ভারতের অন্যতম বৃহৎ আদিবাসী গোষ্ঠী।

দ্রৌপদী মুর্মু তার এলাকার একটি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন।এর পরে তিনি স্নাতক পড়ার জন্য  ভুবনেশ্বর শহরের  রমা দেবী মহিলা কলেজে ভর্তি হন এবং রমা দেবী মহিলা কলেজ থেকেই কলা বিভাগে স্নাতক সম্পূর্ণ করেন।তিনিই তাঁর গ্রামের প্রথম মেয়ে যে জীবনে প্রথমবার কলেজে পা রাখেন।

স্নাতক শেষ করার পর, তিনি ওড়িশা সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগে জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে চাকরি পান। তিনি 1979 সাল থেকে 1983 সাল পর্যন্ত এই কাজ করেন। এরপর 1994 সালে রায়রংপুরের অরবিন্দ ইন্টিগ্রাল এডুকেশন সেন্টারে শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং 1997 সাল পর্যন্ত তিনি শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন।

তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। সে বছর রায়রংপুরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি। রায়রংপুর আসনে ২০০০ ও ২০০৯ সালে বিজেপির তরফে দাঁড়িয়ে ওড়িশা বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হন দ্রৌপদী।২০০০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বিজু জনতা দল ও বিজেপির জোট সরকারে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এই আদিবাসী রাজনীতিক। শুরুতে বাণিজ্য ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিলেও পরবর্তী সময়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার অর্পণ করা হয় তাঁকে। ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তফসিলি সম্প্রদায়ের বিজেপির রাজ্য শাখার সভাপতি ছিলেন দ্রৌপদী মুর্মু।ভারতের সংবিধানে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর সম্প্রদায় হিসেবে এই আদিবাসী গোষ্ঠীর স্বীকৃতি রয়েছে।

২০১৫ সালে ওড়িশার পার্শ্ববর্তী রাজ্য ঝাড়খণ্ডের প্রথম মহিলা গভর্নর হিসেবে নিয়োগের পরেই সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দেন তিনি। ওড়িশার প্রথম আদিবাসী গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত হন দ্রৌপদী। ২০২১ সালের জুলাই পর্যন্ত সে পদে ছিলেন তিনি। রাজ্যপাল হিসেবে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন দ্রৌপদী।তার কার্যালয়ের দরজা সব সময় সব শ্রেণির মানুষের জন্য খোলা থাকত।

 

ব্যক্তিজীবনে দ্রৌপদী মুর্মু শ্যাম চরণ মুর্মুকে বিয়ে করেছিলেন। দ্রৌপদী মুর্মু ও শ্যাম চরণ মুর্মু দুই ছেলে ও এক মেয়ের মা বাবা ছিলিনে।২০০৯ সালে দুঃখজনক মোড় নেয় মুর্মুর জীবন। রহস্যজনক এক পরিস্থিতিতে বড় ছেলেকে হারিয়ে ফেলেন তিনি। এর কয়েক বছর পর দ্বিতীয় ছেলে এবং স্বামীকেও হারান তিনি।দ্রৌপদীর একমাত্ত কন্যা ইতিশ্রী মুমু পেশায় ব্যাংককমী ।গণেশ হেমরম নামে একজন রাগবি খেলোয়ারকে বিয়ে করেছেন তিনি,তদের এক কন্যাও রয়েছে ।

খানিকটা ‘লো-প্রফাইলের’ এই রাজনীতিবিদ আধ্যাত্মিকতায় প্রচণ্ডভাবে বিশ্বাসী এবং তিনি নিয়মিত নিষ্ঠার সঙ্গে ‘ব্রহ্মা কুমারিস’ ধ্যান কৌশল অনুশীলন করেন।২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে স্বামী, দুই ছেলে, মা এবং ভাইকে হারিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়াদ্রৌপদী জীবনে ফিরতে ওই ধ্যান অনুশীলন শুরু করেন।

দূরদর্শনে এক সাক্ষাৎকারে দ্রৌপদী বলেছিলেন, আমি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম এবং গভীর হতাশায় ভুগছিলাম। ২০০৯ সালে ছেলের মৃত্যুর পর থেকে আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না।‘ব্রহ্মা কুমারিস’ ভ্রমণের পর আমি বুঝতে পারি আমাকে এগিয়ে যেতে হবে ।রাজ্যপালের দায়িত্ব ছাড়ার পর রাইরংপুরে নানা সমাজকল্যাণমূলক কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন।



ভারতের এনডিএ সরকার যে তাকে তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে সে খবর তিনি টেলিভিশনের সংবাদ থেকে জানতে পেরেছেন বলে সেই সময় বলেছিলেন, যা তাকে একই সঙ্গে ‘বিস্মিত’ ও ‘আনন্দিত’ করেছে।পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ময়ূরভাঞ্জ জেলার মতো একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন আদিবাসী নারী হিসেবে আমি দেশের সর্বোচ্চ পদের জন্য একজন প্রার্থী নির্বাচিত হতে পারব এমনটি আগে ভাবিনি।

দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পরই প্রথম ভাষণ দেন দ্রৌপদী। তিনি বলেন, "স্বাধীনতার ৭৫ তম বছরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পেয়ে আমি সম্মানিত। স্বাধীন ভারতে জন্মগ্রহণকারী আমিই দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। আমি এক ঐতিহাসিক সময়ে এই দায়িত্ব নিতে পেরে সম্মানিত। সকলের আশীর্বাদে আমি প্রগতিশীল একটি দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছি। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।"রাষ্ট্রপতির কথায়, "রাষ্ট্রপতি পদে পৌঁছানো আমার ব্যক্তিগত কৃতিত্ব নয়, এটি ভারতের প্রতিটি দরিদ্র মানুষের কৃতিত্ব। আমার রাষ্ট্রপতি হওয়া প্রমাণ করে যে, ভারতের দরিদ্ররা শুধু স্বপ্ন দেখতেই নয়, সেই স্বপ্ন পূরণও করতে পারেন।