সংবাদমাধ্যম এমনই উদ্বেগজনক খবর দিয়েছে। বলা হয়েছে অবস্হা অনেকটাই শোচনীয়। বিশেজ্ঞরা সকলেই একমত, অবিলম্বে সংস্কার-সংরক্ষণের কাজ শুরু করতে হবে। কালক্ষেপণে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, ঘটতে পারে মহা বিপর্যয়।

যার কথা বলা হচ্ছে, তার কোনো প্রাণ নেই, নিরেট নিষ্প্রাণ। তারপরেও তা শিল্প, সাহিত্য, পারফিউম আর প্রেম-ভালোবাসার নগরী প্যারিসের প্রাণ। আইফেল টাওয়ারের আরেকটি নাম ‘লৌহমানবী’, ফরাসিতে ‘লা তুর্ ইফেল’। এমন নামকরণের কারণ হলো, টাওয়ারটির মোট ওজন ১০ হাজার ১০০ টন। এর মধ্যে এর ধাতব কাঠামোর ওজন ৭ হাজার ৩০০ টন। টাওয়ারকে ফরাসিতে ‘তুর্’ বলা হয়। নামপদ ‘তুর্’ স্ত্রীলিঙ্গ, তাই সাধারণ ফরাসিরা ভালোবেসে এর নাম দিয়েছে ‘লা ডাম দ্য ফের’ অর্থাৎ লৌহমানবী।

আইফেল টাওয়ার ৩১ মার্চ উদ্বোধন এবং ১৫ মে ১৮৮৯ তারিখে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। সে বছর প্যারিসে আন্তর্জাতিক মেলা উপলক্ষ্যে এমন স্হাপনাটি নির্মাণ করা হয় বিশ্বকে চমক দেওয়ার জন্যই। সেই থেকে ১৩৩ বছর ধরে রোদ, ঝড়, বৃষ্টি, তুষার, কনকনে ঠান্ডা সয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

সমস্যা দেখা দিয়েছে সেখানেই, পানি আর বাতাসের অক্সিজেন মিলে প্রায় সমস্ত শরীর কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে, মরিচা ধরে গেছে অনেক অংশে। তাছাড়া এর সঙ্গে যোগ হয়েছে নগরীর দূষণ। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, স্হাপনাটির অনেক জায়গা বেশ ক্ষয়ে গেছে। পুরো রঙের আস্তরে ঢেকে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো চোখের আড়াল করা সম্ভব হলেও বিপর্যয় এড়ানো অনেকটাই অসম্ভব হবে। তাই তাঁরা পরামর্শ দিচ্ছেন, সময় নষ্ট না করে আইফেল টাওয়ারের সংস্কার এবং সংরক্ষণের জন্য অতি সত্বর যথাযথ ব্যবস্হা নিতে।

এমন বিস্ময়কর টাওয়ারটি পরিকল্পনাকারী ছিলেন ফরাসি প্রকৌশলী আলেকজর্ন্ড গুস্তাভ ইফেল (১৮৩২-১৯২৩)। টাওয়ারটি তৈরি করতে তিনি উন্নতমানের লোহা ব্যবহার করেছিলেন, ইস্পাত নয়। তাঁর সরাসরি তত্ত্বাবধায়নে ৩০০ দক্ষ কর্মী একটানা ২ বছর ২ মাস ৫ দিন কঠোর পরিশ্রম করে নির্মাণ করেছিলেন এ টাওয়ারটি। নির্মাণ শেষে এর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি কিছু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সে অনুসারে প্রতি সাত বছর অন্তর টাওয়ারটিকে রঙের পুরো প্রলেপ দেওয়া হয়। যাতে করে পানি এবং বাতাস মিলে মরিচা ধরে ক্ষয় না করতে পারে। নির্মাণের পর এ পর্যন্ত ১৯ বার রং করা হয়েছে। গত ২০১৯ থেকে ২০ বারের মতো রং করা হচ্ছে, শেষ হবে ২০২২-এর শেষের দিকে। একবার রং করতে প্রয়োজন হয় ৬০ টন উন্নতমানের রঙ।

আইফেল টাওয়ার উদ্বোধনের সময় উচ্চতা ছিল ৩১২ মিটার বা ১০২৪ ফুট, ২০২২-এ চূড়ায় একটি রেডিওর এন্টেনা স্হাপন করলে বর্তমানে এর উচ্চতা দাঁড়ায় ৩৩০ মিটার বা ১০৮৩ ফুট। একটানা ৪২ বছর আইফেল টাওয়ার ছিল বিশ্বের সর্বোচ্চ স্হাপনা। ১৯৩১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৩৮১ মিটার বা ১২৫০ ফুট উচ্চতার ১০২টি তলা বিশিষ্ট এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং, গগনচুম্বী অট্টালিকাটি নির্মিত হলে ‘সর্বোচ্চ’ শিরোপাটি হারায় প্যারিসের আইফেল টাওয়ার।

বর্তমানে আইফেল টাওয়ার ক্ষয় রোগে ভুগছে। অনবরত বাতাসের ঝাপটা এবং তাপমাত্রার ওঠা-নামার কারণেও অনেকটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। জরুরি মেরামত প্রয়োজন। তবে এজন্য এ সময়টা মোটেই অনুকূলে নয়। একদিকে মুদ্রাস্ফীতি এবং সেইসঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সর্বত্র কৃচ্ছÌতা সাধনের কথা বলা হচ্ছে। অন্যদিকে আগামী দুই বছরের মাথায় ২০২৪ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে অলিম্পিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। এমন উত্সবে গোটা বিশ্বকে চমক দেওয়ার জন্য আয়োজকরা সব রকমের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ঠিক এমন নাজুক সময়েই আইফেল টাওয়ারের এমন কাহিল অবস্হার খবর অনেকটা ‘গোদের উপর বিষ ফোঁড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যাঁরা বহুদিন ধরে এমন চমত্কার স্হাপনাটির দেখাশোনা করছেন, তাঁরা জানিয়েছেন যে আইফেল টাওয়ার সংস্কার, সংরক্ষণের কাজ অনেক জটিল এবং বেশ ব্যায়বহুল। তাছাড়া নিরাপত্তার খাতিরে বেশ কয়েক বছর টাওয়ার এলাকায় পর্যটকসহ সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে।

মানুষের গড়া এমন সুউচ্চ স্হাপনাটিকে মহানগরী প্যারিসের প্রাণ বা প্রতীক বললে মোটেই ভুল হবে না। প্যারিসে বেড়াতে এসে আইফেল টাওয়ার না দেখে কেউ ফিরে গেছে, এমন খুবই কম ঘটেছে। প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ পর্যটকের পদভারে মুখরিত হয় টাওয়ার চত্বর।

পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ ‘নত্রর ডাম ডো প্যারি’ ১৫ এবং ১৬ এপ্রিল, ২০১৯ তারিখে ১৫ ঘণ্টা ধরে আগুনে পুড়ে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। পুনঃনির্মাণে হিমশিম খাচ্ছে বিশাল কর্মীবাহিনী। এই মধ্যযুগীয় ক্যাথলিক ক্যাথিড্রাল ফরাসি গথিক স্হাপত্যের বিস্ময়কর স্হাপনাটি দেখতে প্রতি বছর প্যারিসে প্রায় ১ কোটি ১৪ লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটত। পর্যটকদের আনাগোনা সেখানেও কমে গেছে। এরপর আইফেল টাওয়ার পর্যটকদের জন্য নিষিদ্ধ করলে পর্যটনশিল্পের বিপুল ক্ষতি হয়ে যাবে। অথচ আইফেল টাওয়ার পড়ে গেলে, ফ্রান্সের পর্যটনশিল্পে দারুণ ঝাঁকুনি লাগবে, যুদ্ধ এবং অতিমারি সামলিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো অনেকখানি মুশকিল হবে। এ মুহূর্তের দুঃখের সংবাদ হলো—প্যারিসের লৌহমানবী অসুস্হ।

ড. মইনুল হাসান

২১ আগস্ট ২০২২, ০৫:০০

লেখক: ফ্রান্সপ্রবাসী লেখক 

ইত্তেফাক/জেডএইচডি