সভ্যতার চাকা ছুটে চলছে। তবে দাসপ্রথা থেকে মুক্তি মিলছে না। বরং গত পাঁচ বছরে আরও বেড়েছে ‘আধুনিক দাসের’ সংখ্যা। ২০২১ সালে বিশ্বের ৫ কোটি মানুষ আধুনিক দাসত্বে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। ‘বৈশ্বিক আধুনিক দাসত্ব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। আজ সোমবার আইএলও’র ওয়েবসাইটে এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। 

এতে জানা গেছে, ২০১৬ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দাসত্বে বন্দি মানুষের সংখ্যা বেড়েছে এক কোটি। গত পাঁচ বছরে বেড়েছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে শ্রম এবং জোরপূর্বক বিয়ের সংখ্যাও। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), ওয়াক ফ্রি এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (ওআইএম) তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে আধুনিক দাসত্বে বন্দি জীবন কাটানো মানুষগুলোর মধ্যে ২ কোটি ৮০ লাখ মানুষকে জোরপূর্বক কাজ করানো হয়েছে। 

আধুনিক দাসপ্রথা বিশ্বের প্রায় সব দেশেই দেখা গেছে। প্রতিবেদন বলছে, জোরপূর্বক শ্রমের ঘটনার প্রায় ৫২ শতাংশ এবং জোরপূর্বক বিয়ের এক চতুর্থাংশ উচ্চ-মধ্যম ও উচ্চ-আয়ের দেশগুলোতে ঘটেছে।

জোরপূর্বক শ্রমের ঘটনার ৮৬ শতাংশই ঘটেছে বেসরকারি সেক্টরে। বাকি ১৪ শতাংশ রাষ্ট্রীয় খাতে। ২৩ শতাংশ বাণিজ্যিকভাবে জোর করে যৌনকর্মে বাধ্য করার দ্বারা। এভাবে যারা যৌনকর্মে বাধ্য হয়েছেন তাদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে চারজনই নারী ও শিশু। 

জোরপূর্বক শ্রম দিতে যারা বাধ্য হয়েছেন তাদের প্রতি আটজনের মধ্যে শিশুর সংখ্যা অন্তত একজন। শিশুদের এই সংখ্যা ৩৩ লাখ। এসব শিশুর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি বাণিজ্যিক যৌনশ্রম শোষণের শিকার। 

২০২১ সালে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ মানুষকে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সংখ্যা ২০১৬ সালের তুলনায় ৬৬ লাখ বেশি। ১৬ বছর ও তার কম বয়সী শিশুরা উল্লেখযোগ্য হারে এমন বিয়ের শিকার। বাল্যবিয়েকে জোরপূর্বক বিয়ে হিসেবে ধরা হয়। কারণ, এই বিয়ে আইনসম্মত নয়। তবে জোরপূর্বক বিয়ের এই সংখ্যার মধ্যে সব বাল্যবিয়েকে ধরা হয়নি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। 

জোরপূর্বক বিয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশই পারিবারিক চাপের কারণে হয়েছে। ৬৫ শতাংশ সংঘটিত হয়েছে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে। তবে আরবের দেশগুলোতে জোর করে বিয়ের দেওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। হাজারে প্রায় ৫ জনকে সেখানে জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া হয়।  

অভিবাসী শ্রমিকরা অ-অভিবাসীদের তুলনায় তিনগুণ বেশি জোরপূর্বক শ্রমের শিকার বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ওআইএম-এর ডিরেক্টর আন্তোনিও ভিতোরিনো বলেন, এই প্রবণতা দূর করতে বৈশ্বিক অভিবাসন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

ওয়াক ফ্রি’র প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক বলেন, আধুনিক দাসপ্রথা টেকসই উন্নয়নের অন্তরায়। ২০২২ সালে এসেও এই দাসপ্রথা চলমান। এই সমস্যা মানবসৃষ্ট। এ কালের দাসপ্রথার সঙ্গে ঐতিহাসিক দাসত্ব ও স্থায়ী কাঠামোগত বৈষম্য জড়িত। কার্যকর রাজনৈতিক পদক্ষেপ এই মর্মান্তিক মানবাধিকার লঙ্ঘন দূর করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। 

আধুনিক দাসপ্রথার অবসান ঘটাতে প্রতিবেদনে কয়েকটি প্রস্তাবনা উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো- আইন মানতে হবে এবং তা মানা হচ্ছে কিনা দেখতে শ্রমখাতে নজরদারি জোরদার করতে হবে। রাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত জোরপূর্বক শ্রম বন্ধ করতে হবে। মানবপাচার চক্রকে প্রতিহত করতে হবে, এজন্য নিতে হবে শক্তিশালী পদক্ষেপ। সেই সঙ্গে বৈধ নিয়োগের বিষয়ে উৎসাহিত করতে হবে। এছাড়া বাড়াতে হবে সামাজিক নিরাপত্তা। আইনগত নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে এবং ব্যতিক্রম ছাড়াই বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর করতে হবে। নারী, শিশু ও দুর্বলের জন্য সহায়তাও বৃদ্ধি করতে হবে। 

প্রস্তাবিত পদক্ষেপগুলো সমন্বিতভাবে দ্রুত বাস্তবায়ন করা হলে আধুনিক দাসপ্রথা দূর করতে জোরালো ভূমিকা রাখবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। 

হাসনাত কাদীর

সুত্র- সমকাল