বহুজাতিক দেশ হিসেবে ইংল্যান্ডের পরিচিতি বেশ পুরোনো। বিশ্বজুড়ে ব্রিটিশদের কয়েকশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসন তাদের দেশের প্রতি, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের প্রতি সময়ে সময়ে অভিবাসীদের আকর্ষিত করেছে। আমাদের উপমহাদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ ইতোমধ্যে সেখানে পাড়ি জমিয়েছেন, যাদের অনেকেই এখন পুরোদস্তুর ব্রিটিশ। ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের ক্রিকেটার মইন আলির কথাই ধরুন। যার পিতামহ জাতে ছিলেন একজন পাকিস্তানি। পরবর্তীতে যিনি থিতু হন যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্মিংহামে। সেই সুবাদে মইন আলির জন্ম-বেড়ে ওঠাও কিন্তু সেখানেই।

অবশ্য পূর্বপুরুষ পাকিস্তানি হওয়ার কারণে মইন আলি ছোট থেকেই ক্রিকেটের প্রতি টান অনুভব করতে থাকেন। মইন আলির পরিবার ছিলো কিছুটা শ্রমিক শ্রেণির। তবে ক্রিকেটটা তিনি শুরু করেছিলেন বয়সভিত্তিক স্তর থেকেই। ধীরে ধীরে বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে তিনি আজ ইংলিশ দলের পরিচিত মুখ। এছাড়া তার বিশাল দাঁড়ি তাকে পরিণত করেছে ইংল্যান্ডের অন্যতম আলোচিত ক্রীড়াবিদে। মূলত ধর্মের প্রতি তার এই টানের কারণে তিনি আজ বেশ খ্যাতি অর্জন করলেও একটা সময় তার পরিস্থিতি ছিলো একদম ভিন্ন। সেখান থেকে আজকের মইন হয়ে ওঠার গল্পই শোনাবো আজ।

মইন আলির মতে, তখন তিনি শিশু ছিলেন। বার্মিংহামেই তাকে কোরআন তিলওয়াত করার নিয়মসমূহ তথা আরবি হরফের পরিচিতি এবং আরবি শব্দ উচ্চারণের নিয়ম শেখানো হতো। তবে সেসবের অর্থ কখনোই তাদের সেভাবে পড়ানো হতো না। একইসঙ্গে তাদের শিক্ষক ছিলেন একটু কড়া স্বভাবের। ফলে জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে তাদের ধর্ম সম্পর্কে সুন্দর ধারণা গড়ে ওঠেনি। মইনের ভাষ্যমতে, ‘আমরা এটা পর্যন্ত জানতাম না যে আমাদের কী পড়ানো হচ্ছে। এটার কোনো মানেই হয় না।’ যার প্রভাব সরাসরি পড়ে মইন আলির চিন্তা জগতে।

এর পরের ঘটনাটি ২০০০ সালের মধ্যভাগের কোনো একদিনের। ১৮ বছরের তরুণ মইন সেসময় খেলছিলেন ইংল্যান্ড অনুর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে। সেদিন তার ব্যাট আশানুরূপ রানের দেখা পায়নি। তাই কিছুটা বিষণ্ণ মনেই গ্যালারিতে ফিরে যান তিনি। এমন সময় তিনি আবিষ্কার করেন তার পাশে বসে থাকা ক্যারিবিয়ান লোকটি একজন নওমুসলিম। এরপরের ঘটনাগুলো না হয় ইংলিশ অলরাউন্ডারের মুখেই শোনা যাক, ‘আমি (সেদিন) বেশি রান করতে পারিনি। কোনোভাবে আমি সেই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী হই। আমি তার পাশে যাই এবং বসে পড়ি : “ভাই, আমাকে বলো কেন তুমি মুসলিম হয়েছো, কারণ আমার মুসলিম হওয়ার কথা ছিলো কিন্তু আমি এ ব্যাপারে সম্মত নই। (উদাহরণস্বরূপ) আমি আনুষ্ঠানিক বিবাহ (অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ) প্রথাকে সমর্থন করি না।”

ভদ্রলোক ধৈর্যের সঙ্গে আমাকে সাংস্কৃতিক প্রথাসমূহের মাঝে পার্থক্য বোঝাচ্ছিলেন, যেমন আনুষ্ঠানিক বিবাহ, যেটা দক্ষিণ এশীয়দের মাঝে অধিক প্রচলিত এবং ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কে, যেমন সৃষ্টিকর্তার একত্ব , তাঁর গুণাবলী এবং এধরনের বেশ কিছু বিষয়। এটা সত্যিই আমার ভেতরে যেন কিছু একটা শুরু করে দিয়েছিলো।”

এছাড়া আলোচিত নাইন ইলেভেনের ঘটনাও মইনের জীবনে বেশ প্রভাব ফেলে বলে জানান তিনি। মইনের ভাষ্যমতে, টুইন টাওয়ারের সেই ঘটনার পর ব্রিটিশ মুসলিমরা বেশ সোচ্চার হয়ে ওঠেন। মইনের কাজিনরা এর আগে বলিউডের সিনেমা দেখতেন এবং র‍্যাপ সঙ্গীত শুনতেন। তবে এই ঘটনার পর তারাও দাঁড়ি বড় করার সাথে সাথে মাথায় টুপি পরা শুরু করেন। ১৪ বছর বয়সী মইনও সেসময় এই ‘ট্রেন্ড’ অনুসরণ করেন, ‘আমি এটি উপেক্ষা করতে পারিনি। সেসময় মনে হচ্ছিলো, “এটাই আমার জন্য সত্য ।” ’

এদিকে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার পর মইন বলেছিলেন, তিনি ব্রিটিশ মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছেন। তিনি আরও জানান, ক্রিকেট তাকে বেঁচে থাকার উপায় দেখিয়েছে, আর ইসলাম দেখিয়েছে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য। ঘরোয়া লিগে মইন খেলেন ওয়েস্টারশায়ার ক্লাবের হয়ে। যেহেতু মইন নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, তাই তার জন্য ক্লাব কর্তৃপক্ষ আলাদা নামাজ কক্ষের ব্যবস্থা করেছে। আবার রমজানে রোজা রেখেই মাঠে নামেন তিনি। সেজন্য তার ক্লাব বা জাতীয় দল থেকে কখনোই কোনো বাঁধা আসেনি বলে জানান তিনি। ‘এটা আসলে একটি কঠিন সময়, আবার একটি সেরা সময়ও বটে। আমি আসলে (রোজার সময়) অন্যদের চাইতে আলাদা মিশনে থাকি। যা আমার ক্রিকেটের চাপকে দূর করে দেয়’, বলেন মইন। এমনকি রমজানে যেন কষ্ট না হয় সেজন্য সাম্প্রতিক বছরে তিনি অন্যান্য সময়েও খেলা চলাকালে খাবার খাওয়া ও পানীয় পান হতে বিরত থাকার অনুশীলন করছেন।

অবশ্য লম্বা দাঁড়ির কারণে তাকে বেশ কয়েকবার ঝামেলায় পড়তে হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তো বটেই, একবার জন্মভূমি বার্মিংহামেও তাকে বিমানবন্দরে সন্দেহভাজন হিসেবে ৪০ মিনিট যাবত তল্লাশি করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন গত বছর এক টুইটে বলেন, ‘ক্রিকেট না খেললে সিরিয়ায় গিয়ে আইএসে যোগ দিতেন মইন।’ এসময় তিনি সেই টুইটের কোনো উত্তর না দিলেও তার সতীর্থদের অনেকেই এর বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। এর বাইরে ক্যারিয়ারের শুরুতে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ চলাকালে একবার এক অজি তাকে ‘ওসামা’ বলে স্লেজিং করে বেশ আলোচিত ব্যাপারের জন্ম দেন। যদিও মইন কখনোই জনসম্মুখে সেই ক্রিকেটারের নাম প্রকাশ করেননি।

আবার ফিলিস্তিনে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে একবার ‘Save G a z a’, ‘Free P ales tine’ লেখা রিস্টব্যান্ড পরে জাতীয় দলের হয়ে খেলতে নামেন তিনি। মইন বলেন, ‘আমি প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছিলাম। আমাকে উদ্দেশ্য করে চিঠি লেখা হয়েছিলো: আমাকে তোমাকে খুঁজে বের করবো এবং হত্যা করবো।’ মইন অবশ্য সেসবে তেমন প্রভাবিত হননি। বরং দাতব্য কাজের উদ্দেশ্যে সেই ব্যান্ডটি নিলামে বিক্রিও করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি নিয়ে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিলো। তবে মইন জানান, তিনি এমনটি করেছিলেন মানবতার খাতিরে। এতে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ নেই।

ব্যক্তিগত জীবনে মইনের স্ত্রী বাংলাদেশি বংশদ্ভূত ফিরোজা। আবু বকর নামে এক ছেলে এবং হাদিয়া নামের এক ফুটফুটে কন্যা সন্তানের অভিভাবক তারা। অন্যদিকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইংলিশদের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার করা মইন দলটির অন্যতম সক্রিয় খেলোয়াড়। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিন ফর্ম্যাট মিলিয়ে যার নামের পাশে রয়েছে ৫৪৭০ রান ও ৩১৮ উইকেট। দেশের বাইরে আইপিএল, বিপিএল, পিএসএল ও সাউথ আফ্রিকান সুপার টি-টোয়েন্টি লিগেও নিয়মিত দেখা গিয়েছে তাকে।

(এই প্রতিবেদনে ব্রিটিশ পত্রিকা ‘ফিন্যান্সিয়াল টাইমস’-এ প্রকাশিত মইন আলির সাক্ষাকারের কিছু অংশ ব্যবহার করা হয়েছে।)

শাফিন হাসান তাহমীদ/স্পোর্টসজোন-২৪