Print
Hits: 340

 বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ মূল্যস্ম্ফীতির যে প্রবণতা আমরা প্রত্যক্ষ করছি, তার কারণ মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসৃষ্ট অচলাবস্থা। একদিকে যুদ্ধের কারণে জ্বালানির দাম হু হু করে বাড়ছে, অন্যদিকে গম ও ভোজ্যতেলের মতো মৌলিক খাদ্যপণ্যের দামও বাড়ছে। এর পেছনে উৎপাদনজনিত ঘাটতি যত না দায়ী, তার চেয়ে বেশি দায়ী সরবরাহজনিত সমস্যা। বিশ্ববাজারে এখন যে চাল, গম ও ভোজ্যতেলের সংকট চলছে, তা উৎপাদনজনিত নয়; সরবরাহজনিত।

 রাশিয়া ও ইউক্রেন মিলিতভাবে বিশ্ব খাদ্য চাহিদার ৩০ শতাংশ জোগান দেয়। এ বছর ইউক্রেনে খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয়েছে ৮ কোটি টন, যুদ্ধের কারণে যার অন্তত ২০ শতাংশ মাঠেই নষ্ট হয়েছে। বৈশ্বিক গমের চাহিদার ২৫ শতাংশ এবং সূর্যমুখী তেলের ৫৮ শতাংশ রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে আসে। কাজেই সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে খাদ্যমূল্য অবধারিতভাবে আরও বাড়বে। কৃষক মাঠে না যেতে পারায় আগামীতে গম ও ভোজ্যতেল উৎপাদন নিশ্চিতভাবেই কমবে। যে কারণে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) সামনের কয়েক মাসে খাদ্যমূল্য ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ার যে পূর্বাভাস দিয়েছে, তাকে যৌক্তিক বলে ধরে নেওয়া যায়।


২০১৯ সালের শেষার্ধে করোনার শুরু থেকেই বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে। এখনও করোনার অভিঘাত সামাল দিতে হচ্ছে; তদুপরি রাশিয়ার ওপর নানামুখী পাশ্চাত্য নিষেধাজ্ঞা চলছে। এর মধ্যে আবার বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন এখনও শূন্য কভিড নীতিতে চলে সামগ্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়া শ্নথ করে দিয়েছে। এসব কারণে মূলত উন্নত দেশগুলো মূল্যস্ম্ফীতির কোপানলে। তবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল ওউদীয়মান দেশগুলোর বতর্মান উচ্চ মূল্যস্ম্ফীতির পেছনে নিয়ামক ভূমিকা রাখছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্য, জ্বালানি তেল, গ্যাস ইত্যাদির দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের কারসাজিতে ডলারের মূল্যমানে ঊর্ধ্বগতিপ্রবণতা সৃষ্টি হওয়া। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য ৩০-৩২ শতাংশ বাড়ায় বাংলাদেশের জ্বালানি ও খাদ্য আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। একদিকে বাড়তি আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভে টান পড়ছে, অন্যদিকে করোনার সময় দেওয়া সরকারের বিশাল অঙ্কের প্রণোদনার অর্থ নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর হাতে গিয়ে অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যবহূত হচ্ছে, যা অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।

করোনার অভিঘাত ও বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক সংকটে পড়ে বিশ্বের অনেক দেশই অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুযায়ী নীতি সুদহার বাড়িয়ে তারল্য সংকট ও মূল্যস্ম্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করছে। অতীতে অর্থনীতির এই তত্ত্বের কিছু সুফলও পাওয়া গেছে। কিন্তু করোনাভাইরাস-সৃষ্ট অভূতপূর্ব সংকট এবং পরিবর্তনে জেরবার বর্তমান বিশ্বে অর্থনীতির প্রথাগত অনেক তত্ত্বই খুব একটা কাজে আসছে না।

বিশ্বের অনেক অর্থনীতিবিদই এখন বলছেন, সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রচলিত পদ্ধতির অসারতা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। কারণ এই পদ্ধতি অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেয়। মার্কিন অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎস বলছেন, 'বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গণহারে সুদহার বৃদ্ধি ওভারডোজ হয়ে যাচ্ছে। চাহিদা হ্রাস করে এবং বেকারত্বের হার বাড়তে দিয়ে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটানোর কোনো মানেই হয় না। এই নীতি কিছুদিন চললে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে ঠিকই, কিন্তু তাতে নিম্ন আয় ও সাধারণ মানুষের জীবন নিঃশেষ হয়ে যাবে।

' পুঁজিবাদ ও মুক্তবাজারের ফেরিওয়ালা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বারবার সতর্ক করে বলছে, মূল্যস্ম্ফীতি মোকাবিলায় বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যেভাবে নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে, তাতে আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায় পড়বে। এত সমালোচনা ও সতর্কবাণী সত্ত্বেও ডলার দিয়ে আর্থিকীকরণকৃত বিশ্ব অর্থনীতি ব্যবস্থার মূল চালক যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক গত সেপ্টেম্বরে এক বছরে রেকর্ড পঞ্চমবারের মতো এক ধাক্কায় শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ পয়েন্ট হারে নীতি সুদহার বাড়িয়েছে এবং তা আরও বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছে। এতে গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ম্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কিছুটা কমে চলতি মাসে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু যে হারে দেশটিতে নীতি সুদহার পরিবর্তন করা হয়েছে, তাতে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মূল্যস্ম্ফীতি কমার প্রবণতা প্রত্যাশিত হারের ধারেকাছেওযেতে পারেনি। অথচ এর ফলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সংকট আরও ঘনীভূত হচ্ছে। উপরন্তু, উন্নত দেশগুলোর মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায়বিশ্ব এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার দিকেধাবিত হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের চূড়ান্ত স্বার্থপর এই আচরণের গূঢ় কারণ হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের করা বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিজ দেশে নিয়ে যাওয়া এবং সেই অর্থ দেশটির নবায়নযোগ্য ও প্রাকৃতিক গ্যাস ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ করে ইউরোপে রাশিয়ার জ্বালানিশূন্য বাজার দখল করা। ইউক্রেন যুদ্ধে ইন্ধন জুগিয়ে আট মাসের মাথায় রাশিয়ার ৬০ শতাংশ জ্বালানি গ্যাস রপ্তানি ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার পর সারাবিশ্বে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রই সর্বোচ্চ গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ। ইউরোপে গ্যাস রপ্তানির শীর্ষস্থানটি এখন রাশিয়ার কাছ থেকে নরওয়ের হাতে চলে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের সব ধরনের গ্যাস ও তেলের বাজার দখলে নিতে জল-স্থল-আকাশের পাশাপাশি আর্থিকীকরণ ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে ডলার দিয়ে বাজার কারসাজির চিরাচরিত পদ্ধতি আবারও প্রয়োগ করছে। দেশটির স্বার্থপর আচরণ বিশ্বের উন্নয়নশীল ও বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর জন্য চরম বিপদ ডেকে আনলেও নীতি সুদহার ক্রমে বাড়িয়ে তারা এই বার্তাই দিচ্ছে- মন্দায় পড়ে মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠলেও কিছু করার নেই।


এ রকম বিশ্ব প্রেক্ষাপটে রেপো বা নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ম্ফীতি কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, তা নিয়ে বাংলাদেশকে ভালো করে ভাবতে হবে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মোট চাহিদা পণ্যের ২৩ শতাংশ বাইরে থেকে আমদানি হয়; ৭৭ শতাংশ পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। ফলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদন কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন ও গতিশীল রাখা গেলে বাংলাদেশের মূল্যস্ম্ফীতি ততটা প্রকট আকার ধারণ করার কথা নয়।


বর্তমান অবস্থায় বিনিয়োগ ও উৎপাদনকে বিভিন্ন রকম সুদের ফাঁসে আটকে না রেখে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কিছুটা কৃচ্ছ্র ও সংযম সাধন করে, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় দিয়ে আমদানি ব্যয়কে অতিক্রম করিয়ে নিতে পারলে বাংলাদেশের পক্ষে মূল্যস্ম্ফীতিপ্রবণতা কমিয়ে আনা এবং সহনীয় রাখা খুবই সম্ভব। পাশাপাশি আর্থিক ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে পারলে বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী আসন্ন ভয়াবহ আর্থিক বিপর্যয় ও মন্দার মধ্যেও ক্ষতি তুলনামূলক কমিয়ে রাখতে পারবে। এখন বাংলাদেশকে ব্যয় সংকোচনের প্রতি বিশেষ জোর দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় বিভিন্ন উৎপাদন সম্ভাবনাকেসর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা কার্যক্রম গতিশীল করার পথ সুগম করতে হবে। কারণ অতীতে দেখা গেছে, সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে বড় অর্থনীতির দেশের আর্থিক মন্দা ছোট অর্থনীতির দেশের জন্য শাপেবর হয়। এ জন্য বাংলাদেশকে তার সীমিত সম্পদের সৃজনশীল ও সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

আইনুল ইসলাম


ড. আইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

সূত্র-দৈনিক সমকাল

আরও পড়ুন

দেশে মধুর বাজার এখন ৭৫০ কোটি টাকার 

এইচএসবিসি গ্লোবাল রিসার্চের প্রতিবেদন ২০৩০ সালের মধ্যে জার্মানি-যুক্তরাজ্যকে পেছনে ফেলবে বাংলাদেশ

দৈনিক ক্ষতি ২ হাজার কোটি টাকা