সানেমের পর্যালোচনা

চলমান অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ম্ফীতির চাপ কেবল বাংলাদেশের নয়, এটি বৈশ্বিক সংকট। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থা মাঝারি পর্যায়ের। বাংলাদেশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম সংকটে থাকা দেশ যেমন আছে, তেমনি বেশি সংকটে পড়া দেশও আছে। বাংলাদেশের মূল্যস্ম্ফীতি যেখানে ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ, সেখানে পাকিস্তানে ২০ শতাংশ এবং তুরস্কে ২৫ শতাংশের ওপরে। আবার ভিয়েতনামে এ হার ৪ দশমিক ৩০ শতাংশ এবং ভারতে ৫ দশমিক ৭১ শতাংশ।

বৃহস্পতিবার 'বাংলাদেশের অর্থনীতি: উদ্বেগের জায়গা ও করণীয়' শীর্ষক এক ওয়েবিনারে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান এমন পর্যালোচনা তুলে ধরেন। আলোচ্য বিষয়ের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনের পাশাপাশি অংশগ্রহণকারীদের নানা প্রশ্নের উত্তরও দেন তিনি।তিনি বলেন, সংকটের নেপথ্যে বৈশ্বিক খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি যেমন রয়েছে, তেমনি অভ্যন্তরীণ সংকট ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, বিশেষত চাহিদা ও জোগান-সংক্রান্ত তথ্যের ঘাটতিও একটি বড় কারণ। হালনাগাদ তথ্য সরকারের কাছে নেই। এখন দারিদ্র্যের হার কত বা কর্মসংস্থানের কী পরিস্থিতি, তা সরকার বা কেউ তা বলতে পারবে না। সরকারি প্রতিষ্ঠান বিবিএসের এ কাজ করার কথা। কিন্তু তারা করছে না। মাঝে ত্রৈমাসিক শ্রম জরিপ শুরু করে থেমে গেছে।

বাংলাদেশের চলমান সংকটের ক্ষেত্রে নীতি পক্ষাঘাতগ্রস্ততা রয়েছে মন্তব্য করে সেলিম রায়হান বলেন, নীতি-সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাস্তবভিত্তিক ও প্রকৃত তথ্য থাকা দরকার। এ কাজ বিবিএসের। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির তথ্য পাওয়ারও কোনো চেষ্টা নেই। ফলে পুরোনো ও ভুল তথ্যে নির্ভর করে সংকট মোকাবিলায় কার্যকর ও কাঙ্ক্ষিত ফল মিলছে না।

সেলিম রায়হান বলেন, এত বড় করোনাভাইরাস মহামারি গেল, কিন্তু এর অভিঘাত নিয়ে সরকারি তথ্য নেই। অনেকটা আন্দাজের ভিত্তিতে নীতি-সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। আমাদের উৎপাদন কত, এর প্রকৃত তথ্য নেই। যা আছে অনুমানভিত্তিক। আবার জনসংখ্যা নিয়েও নানা মত আছে। মোট জনসংখ্যার হিসাবে যদি ১০ লাখ মানুষও কম ধরা হয়, তবে চাহিদা কম ধরা হবে। এভাবে যে জোগান নিশ্চিত করা হবে, তাতে একসময় ঘাটতি দেখা দেবেই। আর এ সময় বাজার স্বার্থান্বেষীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। বাস্তবেও তাই হচ্ছে।

সানেমের নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, এভাবে সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলেই মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার হওয়ার পরও সবাই মাছ-মাংস খেতে পারছে না। খাদ্যতালিকা থেকে অনেকে এগুলো বাদ দিচ্ছে। এখনও এ দেশে এসব খাদ্যকে বিলাসী খাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এটা কী করে সম্ভব!

সেলিম রায়হান বলেন, সব দেশের জন্য মূল্যস্ম্ফীতি মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক দেশে আমাদের দেশের তুলনায়ও এটা খুব বেশি। আবার কিছু দেশের মূল্যস্ম্ফীতি আমাদের চেয়ে কম। যেমন- ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ভারত। এ দেশগুলো বৈশ্বিক অভিঘাত মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সংকটের প্রভাব কমাতে পেরেছে।

অর্থনৈতিক সংকটে প্রান্তিক ও দরিদ্র মানুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে তাদের জন্য সরকারের বিশেষ নজর রাখার আহ্বান জানিয়ে এ গবেষক বলেন, সহযোগী একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ পোশাক শ্রমিকের সাপ্তাহিক তথ্য সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। এসব তথ্য বিশ্নেষণে দেখা যাচ্ছে, গত জুলাই থেকে তাদের খাদ্য নিরাপত্তা কমেছে। কারণ, এপ্রিল থেকে বেতন ও ওভারটাইম ভাতা কমছে।

এখনকার মূল্যস্ম্ফীতির জন্য প্রধানত কারণ চারটি রয়েছে বলে মনে করেন সেলিম রায়হান। এগুলো হলো- খাদ্য ও জ্বালানির বৈশ্বিক দাম বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন হ্রাস, সরবরাহে ঘাটতি এবং টাকার মূল্যমান কমে যাওয়া।
দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার বিষয়ে সেলিম রায়হান বলেন, গত বছরের বেশি আমদানির খেসারত দিতে হচ্ছে। প্রতি মাসে ১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ কমেছে। এটা কমানো দরকার। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার দীর্ঘ সময় কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা হয়েছিল। এরও অভিঘাত আছে। ভারত, ভিয়েতনাম ধীরে ধীরে সমন্বয় করেছে বলে তারা কম সমস্যায় আছে। সুখবর এটুকু, গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে এলসি খোলা কমেছে। তবে রপ্তানি কমতে পারে, যা মাথায় রাখতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনার কথা ৩০ বছর ধরে বলা হচ্ছে। কাজ হয়নি। রিজার্ভ সুরক্ষায় হুন্ডির লাগাম টানতে হবে। এজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার।

তিনি মনে করেন, ব্যবসা ও উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে কমতে পারে। দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে বলা হচ্ছে। দুর্ভিক্ষ শব্দে তাঁর আপত্তি আছে। কারণ, এতে আতঙ্ক ছড়ায় এবং স্বার্থান্বেষীরা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। তাঁর মতে, খাদ্য নিয়ে এখনও উদ্বেগের জায়গা কম। তবে এখন যেভাবে চলছে, তা ঠেকানো না গেলে বড় সমস্যা তৈরি করবে। আমাদের মাটি উর্বর হলেও উৎপাদন বাড়ানোর কাজে এখনও কিছুটা পিছিয়ে। তার ওপর কৃষিজমির পরিমাণ কমছে।
সানেম নির্বাহী প্রধান বলেন, দেশে ডলার যতটা আসছে, তার চেয়ে দায় ও পরিশোধ অনেক বেড়েছে। বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপি কম বলে অনেকে দাবি করেন। এটা ঠিক। কিন্তু কতদিন থাকবে তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। সরকারি ঋণের মতো বেসরকারি ঋণ বাড়ছে। এটাও মাথায় রাখতে হবে।

আরও পড়ুন

মোবাইলে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন

মাত্র ১৮ ডলার দিয়ে যেভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা শুরু

বাংলাদেশকে আইএমএফ-এর 'গ্রিন সিগন্যাল', পাঁচ শর্তে দেয়া হবে ঋণ