দেশে গত এক দশকে অর্থনীতির আকার বেড়েছে কয়েক গুণ। যদিও এর সঙ্গে সংগতি রেখে শক্তিশালী করা যায়নি দেশের কর তথা রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থার ভিত্তিকে। এখনো দক্ষিণ এশিয়ায় করযোগ্য ব্যক্তি সংখ্যার বিপরীতে রিটার্নদাতার হারে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ করই রয়ে গিয়েছে রাজস্ব কাঠামোর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে। করদাতারাও কেন্দ্রীভূত প্রধান দুই শহর রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে।


জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নানা পরিসংখ্যান তুলে ধরে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতি বড় হলেও রাজস্ব আহরণ তথা কর কাঠামোর সূচকে তেমন কোনো উন্নতি করতে পারেনি বাংলাদেশ। এখনো দেশে করনীতি প্রণয়ন ও আদায় দুটো কাজেরই গুরুভার একক একটি সংস্থার ওপর ন্যস্ত। কর পরিশোধ ব্যবস্থারও সহজীকরণ হয়নি। সাধারণ করদাতাদের মধ্য থেকেও দূর করা যায়নি হয়রানির ভয়। করজাল বড় করার বিষয়টিও সীমাবদ্ধ থাকছে শুধু আলোচনায়ই।


দক্ষিণ এশিয়ায় ই-টিআইএনধারী ব্যক্তি সংখ্যার বিপরীতে রিটার্নদাতার হারের দিক থেকে এখনো সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ই-টিআইএনধারীর সংখ্যা প্রায় ৭৪ লাখ। ২০২০-২১ অর্থবছরে এর বিপরীতে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছে প্রায় ২৪ লাখ। সে অনুযায়ী, দেশে করযোগ্য ব্যক্তির মাত্র ৩১ শতাংশ তাদের আয়কর রিটার্ন জমা দেয়। এ অঞ্চলের অন্য সব দেশেই এ হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি।


এ অঞ্চলে ই-টিআইএনধারীর সংখ্যার বিপরীতে রিটার্ন জমা দেয়ার হার সবচেয়ে বেশি শ্রীলংকায়। দেশটির ৮৮ শতাংশ ই-টিআইএনধারী তাদের রিটার্ন জমা দিচ্ছে। নেপাল ও ভারতে এ হার যথাক্রমে ৭২ ও ৭১ শতাংশ। এছাড়া ভুটান ও পাকিস্তানে যথাক্রমে ৪৪ ও ৩৩ শতাংশ ই-টিআইএনধারী আয়কর রিটার্ন জমা দিচ্ছে।


দেশের কর আহরণ ব্যবস্থার ভিত্তি শক্তিশালী করতে না পারার পেছনে সনাতনী কর কাঠামোকে দায়ী করছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের এখানে ২০০ বছরের পুরনো কর কাঠামো এখনো চলছে। পৃথিবীর সব দেশই তাদের কর কাঠামোর উন্নয়ন করেছে। আমাদের এখানে বড় সমস্যা করনীতি প্রণয়ন ও কর আহরণ কার্যক্রম একটি প্রতিষ্ঠানের ওপরই ন্যস্ত। এটি আলাদা করা প্রয়োজন। যারা নীতি প্রণয়ন করবে তাদের সঙ্গে কর আহরণকারীদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ থাকবে না। আবার করদাতা ও আহরণকারীর মধ্যেও কোনো যোগাযোগের সুযোগ বা একে অন্যকে চেনার কোনো সুযোগ থাকা বাঞ্ছনীয় নয়। কোড নাম্বার অনুযায়ী কর পরিশোধ হতে হবে, উভয় পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ হবে ই-মেইলে। এক স্থানের কর্মকর্তারা অন্য স্থানে কর আহরণ করবেন। তাহলে যোগাযোগের সুযোগ থাকবে না। তখন স্বচ্ছতা আসবে।

আরও পড়ুন

একটি দেশ কি দেউলিয়া হতে পারে?


তিনি আরো বলেন, এখন তো করদাতাদের নানাভাবে হেনস্তা করা হয়। দেখা গেল একজন মানুষ ৩০-৪০ বছর ধরে ৭০ লাখ টাকা জমিয়েছেন। তিনি নিজ থেকে কর দিতে গেলেন। কিন্তু টাকার উৎস নিয়ে হয়রানি হলে তিনি তা কীভাবে দেবেন? এখানে একটি আইন থাকা প্রয়োজন, যাতে যৌক্তিক একটা অংক পর্যন্ত প্রথমবার কর দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো উৎস জানতে চাওয়া হবে না। কোনো হয়রানির মুখে পড়তে হবে না। তাহলে মানুষের মধ্যে কর দেয়ার আগ্রহ বাড়বে। আবার এখন দেখা যাচ্ছে অটোমেশন হলেও তা পুরোপুরি হয়নি। কিছু কাজ অনলাইনে করতে হয়, আবার কিছু নিজে সশরীরে উপস্থিত থেকেও করতে হয়। মানুষ এত ঝামেলায় যেতে চায় না। তারা চায় সহজভাবে কাজ করতে। সেটিও দেখতে হবে।


করদাতা হিসেবে প্রতি বছরই নতুন অনেক মানুষ তালিকাভুক্ত হচ্ছে। ই-টিআইএনধারীর সংখ্যা বাড়লেও সেখান থেকে কর আহরণের হার প্রতি বছরই কমছে। ২০১৯ সালে দেশে ই-টিআইএনধারী ছিল ৪৩ লাখ। ২০২১ সালের মধ্যে তা আরো ৩১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪ লাখে। আবার একই সময়ে প্রতি ই-টিআইএনধারীর বিপরীতে কর আহরণের পরিমাণ ১ লাখ ৪৩ হাজার ৯৪২ টাকা থেকে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ কমে নেমে এসেছে ১ লাখ ১২ হাজার ৯৭৫ টাকায়।


জিডিপির বিপরীতে কর আহরণের দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল অবস্থানে বাংলাদেশ। এখনো দেশের কর আহরণ ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি পরোক্ষ কর। এনবিআরের তথ্যমতে, দেশে মোট আহরিত করে প্রত্যক্ষ করের অবদান মাত্র ৩৩ শতাংশ। বাকিটুকু আসছে পরোক্ষ করের মাধ্যমে। জিডিপির বিপরীতে প্রত্যক্ষ কর আহরণের হিসেবে শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, গোটা বিশ্বেই বাংলাদেশের অবস্থান বেশ দুর্বল বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।


ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাও দীর্ঘদিন ধরেই দেশের কর ব্যবস্থায় সংস্কারের দাবি তুলে আসছেন। কর ভিত্তির দুর্বলতাকে দেশের গোটা রাজস্ব আহরণ ব্যবস্থার অগ্রগতির প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখছেন তারাও। বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারপারসন ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান বলেন, আমাদের অর্থনীতির যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার সঙ্গে সংগতি রেখে আয়কর-রাজস্বের পরিমাণ বাড়েনি। ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাতের যে হার প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৪ শতাংশ নির্ধারণ করেছিলেন, তার ধারেকাছেও আমরা যেতে পারিনি। সুতরাং কর ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য আমরা অনেক বছর ধরেই বলে আসছি। সংস্কারমূলক সুপারিশ হিসেবে আমরা বলেছি, যারা কর আহরণ করেন এবং যারা নীতিনির্ধারণ করেন তাদের মধ্যে ব্যবধান থাকতে হবে। এটি হলে কর ব্যবস্থা আধুনিক হবে। একসঙ্গে থাকলে সেখানে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। আমাদের করজালও ছোট। সেটি বাড়ছে না কেন, তাও গভীরে গিয়ে দেখতে হবে।

আরও পড়ুন

আয়কর রিটার্ন জমা না দিলে যেসব সমস্যায় পড়বেন


তিনি আরো বলেন, কর ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাগুলোও খুঁজে বের করতে হবে। মানুষ কর দিতে চাচ্ছে না। কারণ কর দেয়া নিয়ে এক ধরনের ভয়ভীতি কাজ করে। এজন্য বাড়তি কোনো ঝামেলা তৈরি হবে কিনা। এছাড়া অডিটের জন্য যে চিঠি ইস্যু করা হয়, তার ভাষা দেখেও অনেকে ভয় পান। এছাড়া করদাতাদের জন্য সরকারি সেবায় আলাদা সুবিধা দেয়ার জন্য কার্ডের ব্যবস্থা করা বা জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে আয়করকে সমন্বিত করা যেতে পারে। রিটার্নকে আরো সহজ করার পাশাপাশি ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গেও এটির সমন্বয় করা প্রয়োজন।


দেশে কর আহরণের বিষয়টি স্থানিক পর্যায়ে এখনো রাজধানী ঢাকায়ই সীমাবদ্ধ। মোট আহরিত করের প্রায় ৭৪ শতাংশই আসছে ঢাকা থেকে। চট্টগ্রাম থেকে আসছে প্রায় ১৬ শতাংশ। অর্থাৎ মোট কর আহরণের প্রায় ৯০ শতাংশই আসছে শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে। যদিও ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরেও অনেক এলাকায় ব্যাপক মাত্রায় উন্নয়ন ও শিল্পায়ন ঘটেছে। এজন্য সক্ষমতার অভাবকেই দায়ী করছে এনবিআর। দেশের ৪৯৫টি উপজেলার মধ্যে বর্তমানে মাত্র ৮২টিতে কর পরিশোধের ব্যবস্থা আছে। বাকি ৪১৩ উপজেলায় কর আহরণের মতো অবকাঠামো বা জনবল নেই এনবিআরের।

সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত গত কয়েক অর্থবছরের আয়কর আহরণের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, এ সময়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট ৫২ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা আয়কর হিসেবে আহরণ করেছে এনবিআর। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৬৯ হাজার ৭৪ কোটি টাকায়। ২০২০-২১ অর্থবছরে আয়কর আহরণ হয়েছে ৮৬ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা।


সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ১০ বছর আগের সঙ্গে আমাদের এখনকার আহরণের তুলনা করলে দেখা যাবে, আমাদের রাজস্ব আহরণ প্রায় ৩০০ শতাংশ বেড়েছে। রাজস্ব কাঠামো ও ব্যবস্থাপনার উন্নতি না হলে তা সম্ভব হতো না। আমাদের যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে তার সঙ্গে সংগতি রেখে কর-জিডিপি অনুপাত না বাড়ার কারণ হলো আমরা মেগা প্রকল্পে লাখ কোটি টাকার কর অব্যাহতি দিচ্ছি। প্রতিটি উপজেলায় এনবিআরকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি এখন প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো ঢাকা ও চট্টগ্রামেই কেন্দ্রীভূত। এজন্য কর আহরণের বিষয়টিও এ দুই শহরে কেন্দ্রীভূত। সব জায়গায় আমাদের সুষম উন্নয়ন না হওয়ায় রাজস্বও সুষমভাবে সব জায়গা থেকে আসছে না। এছাড়া পৃথিবীতে রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে একটি অনুসৃত কাঠামো হলো রাজস্ব বোর্ড ফাঁকি উদ্ঘাটন করবে, কিন্তু রাজস্ব আহরণ করবে না। পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন এজেন্সি ট্যাক্স কেটে রাখে। সরকারি কর্তৃপক্ষ শুধু যাচাই করে তার হিসাব ঠিক আছে কিনা। তবে আমরা যতটুকু আশা করেছিলাম, এনবিআরের কাঠামোতেও সে পরিমাণে ডিজিটাইজ করা যায়নি। এখন ডিজিটাল রিটার্ন জমা দেয়া যায়, তাও স্বল্পমাত্রায়। করদাতারা শুধু জমা দিতে পারেন। পদ্ধতিটি বড় করদাতাদের যেসব নথি জমা দিতে হয়, সেটির উপযোগী নয়। আবার একসময় মানুষ বিভিন্ন কারণে টিআইএন নিয়েছে, কিন্তু রিটার্ন দেয়নি। এখন আইন করা হয়েছে, টিআইএন থাকলে বাধ্যতামূলকভাবে রিটার্ন জমা দিতে হবে এবং এ প্রক্রিয়া আরো সহজ করা হচ্ছে। ধীরে ধীরে রিটার্ন বাড়বে।

সূত্র-বণিক বার্তা

আরও পড়ুন

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট মাঝারি পর্যায়ের

মোবাইলে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন

মাত্র ১৮ ডলার দিয়ে যেভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা শুরু