বাংলাদেশে পণ্য আমদানিতে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধানে বিশেষ 'ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেল' খোলার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের সরকার।বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সেল ঋণপত্রের ধরন বুঝে সমাধানের দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।সেই সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থা, ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ব্যবসায়ীদের সমস্যা জানা এবং সমাধানে কাজ করবে এই কমিটি।

বাংলাদেশে এই বছরে মাঝামাঝিতে ডলার সংকট শুরু হওয়ার পর থেকেই ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছিলেন যে, ব্যাংক রাজি না হওয়ায় পণ্য আমদানি করার জন্য তারা ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না।সেই সমস্যা সমাধানেই এসব পদক্ষেপ নিচ্ছে বাংলাদেশের সরকার।তবে ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার সংকট পুরোপুরি সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জটিলতার নিরসন হবে না।

ডলার সংকট তীব্র
বাংলাদেশ গত মে মাস থেকেই ডলারের সংকট তীব্র হতে শুরু করেছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কারণে একদিকে যেমন ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়েছে, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোয় তৈরি হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট।এমনকি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইনের সরঞ্জাম আমদানি করতে বহু বৈঠক করতে হয়েছে।পাশাপাশি এক বছর আগের খোলা পুরনো বা বিলম্বিত এলসির দায় এখন মেটাতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে।

বাংলাদেশের আমদানিকারকরা কয়েকমাস ধরেই অভিযোগ করছেন, ডলার সংকটের কারণে একাধিক ব্যাংকে যোগাযোগ করেও তারা এলসি খুলতে পারছেন না। ফলে অনেক জরুরি পণ্য আমদানি কমে যাওয়ায় দেশের বাজারে দাম বাড়ছে।চলতি বছরের মার্চ মাসে যেখানে ৯৮০ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল, সেখানে অক্টোবরে এলসি খোলা হয়েছে মাত্র ৪৭২ কোটি ডলারের।বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন পাবলিকলি লিস্টেট কোম্পানিজের (বিএপিএলসি) সাবেক সভাপতি আজম জে চৌধুরী মঙ্গলবার একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমদানির জন্য তারা এখন এলসি পর্যন্ত খুলতে পারছেন না।
''অনেক ব্যাংকে ঘুরেও এলসি খোলা যাচ্ছে না। এলসি খোলার জন্য আমি ২০ ব্যাংকের এমডির সঙ্গে কথা বলেছি। এর আগে কখনো ব্যাংকের এমডির সঙ্গে কথা বলতে হয়নি। যেটা এখন বলতে হচ্ছে। কিন্তু এলসি খুলতে না পারলে ব্যবসা করব কীভাবে?’’ তিনি বলেন।

ব্যাংকের প্রতি নির্দেশ
রবিবার বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত বাণিজ্য সহায়ক পরামর্শক কমিটিতে এই সমস্যা নিয়ে নিয়ে আলোচনা হয়।বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, এসব সমস্যা সমাধান করার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি সমন্বয় কমিটি থাকবে।''সমস্যা সমাধানে যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার, সেটা নেয়া হবে,‘’ তিনি বলেন।ডলার সংকট না মেটা পর্যন্ত হয়তো আমদানি খাত পুরোপুরি স্বাভাবিক হবে না বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।তবে বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে নিত্যপণ্যের এলসি সহজ করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এলসি নিয়ে ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধানে একটি ক্রাইসিস সেল খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মোহাম্মদ মেজবাউল হক।সমস্ত ব্যাংকে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের এলসি খুলতে হবে,'' তিনি জানান।''কোন সমস্যা থাকলে আমাদের জানাতে বলেছি, আমরা নীতি ও সহায়তা দেবো। সব ব্যাংকে আমরা বলেছি, এটা যাতে কোনভাবেই কোন ইস্যু তৈরি না হয়,‘’ তিনি বলেন।

বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি
কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বরাবরই বলে আসছে, আমদানির জন্য যতটা চাহিদা রয়েছে, তাদের কাছে ততো ডলার নেই।ফলে ব্যাংকের নির্বাহীরা স্বীকার করেছেন, ডলার সংকটের কারণে এলসির সংখ্যা কমানো হয়েছে।এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সভাপতি সেলিম আর এফ হুসেইন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এলসি খোলা নিয়ে কোন সমস্যা নাই, সমস্যা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি।'সব ব্যাংকই এই সমস্যায় ভুগছে। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তারা সহায়তা দেবেন বলেছেন। হয়তো এখন সমস্যা কমে যাবে,‘’ তিনি বলেন।

কিন্তু ব্যাংকের কাছে যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রা না থাকলে কীভাবে তারা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন?বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মি. হক বলছেন, ‘’ডলার যে নেই তা নয়। রেমিট্যান্স আসছে, রপ্তানি আয় আসছে। তারপরেও কোন ব্যাংকের যদি সমস্যা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক তো সবসময়েই সহায়তা দিয়ে আসছে, আমরা প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দেবো।‘’

রমজানের সময় গুরুত্ব
সামনের বছর মার্চ মাস নাগাদ মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় মাস রমজান শুরু হতে যাচ্ছে।বাংলাদেশে এই সময় কিছু কিছু খাদ্যপণ্যের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।এবার বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আর এলসি খুলতে না পারায় সংকট ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা করছেন চট্টগ্রামের একজন আমদানিকারক আবুল বাশার চৌধুরী।আবুল বাশার চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রার যে চাপ আছে, সেজন্য ব্যাংকগুলো এলসি করার জন্য অনীহা বোধ করছে।

''তারাও বাইরের পেমেন্টগুলো দিতে পারছে না। তাই আগের মতো আমরা সহজে এলসি করতে পারছি না, ব্যাংকও অনেক যাচাই-বাছাই করছে,‘’ তিনি বলেন।’কিন্তু সামনে রমজান। সেসময়ের জন্য খাদ্যদ্রব্য আমদানি করতে হলে এখনি এলসি খুলতে হবে। সেটা যদি আমরা করতে না পারি, তাহলে হয়তো রমজানের সময় একটা সরবরাহের সংকট তৈরি হতে পারে,‘’ তিনি জানান।বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েরতথ্য অনুযায়ী, রমজানে বাংলাদেশে ছোলা, ডাল, চিনি মিলিয়ে নানারকম খাদ্যপণ্য আমদানি করতে আড়াইশো কোটি ডলার দরকার হবে।কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগতে থাকা বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো এই অর্থের যোগান কতটা দিতে পারবেন, তা নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে।তবে সরবরাহ আর মজুদ স্বাভাবিক রাখতে তারা কিছু পণ্য আমদানি করতে প্রায়োরিটি ভিত্তিতে এলসি খুলে দেয়ার ব্যবস্থার কথা ভাবছেন। এক্ষেত্রে এসব পণ্য আমদানির জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এলসি খুলতে হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে।

বিশেষ করে আসন্ন রমজানের জন্য জরুরি সাতটি খাদ্যপণ্য আমদানিতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার কথা ভাবছে সরকার, যার মধ্যে আছে ছোলা, ডাল, খেজুর, তেল, চিনি ও গমের মতো পণ্য।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান বলেছেন, ‘’কোনগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, সেই তালিকা তো আমাদের কাছে আছে। সেগুলো আমদানি করতে যাতে কোন রকম সমস্যা না হয়, সহজে এলসি খুলতে পারে, সেই ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি।‘’

এর মধ্যেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে এলসি খোলা সহজ করার জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ঋণপত্র খোলা নিয়ে তাদের আপত্তি না থাকলেও ডলার সংকট না মেটা অথবা ডলারের যোগান না পেলে খুব বেশি কিছু করা তাদের পক্ষে হয়তো সম্ভব হবে না।

সূত্র-বিবিসি বাংলা

আরও পড়ুন

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দুর্বল কর ভিত্তি বাংলাদেশের

একটি দেশ কি দেউলিয়া হতে পারে?

আয়কর রিটার্ন জমা না দিলে যেসব সমস্যায় পড়বেন