যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে সাধারণত ক্ষমতাসীন সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ভালো ফল করে না। তার ওপর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টির জন্য এবার পরিবেশ ছিল আরও প্রতিকূল। এরপরও মধ্যবর্তী নির্বাচনে ‘লাল ঢেউয়ের’ যে স্বপ্ন দেখেছিলেন রিপাবলিকানরা, বাস্তবে তেমনটা হয়নি। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় কাজ করেছে বলে রয়টার্সের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে।

মধ্যবর্তী নির্বাচনে জর্জিয়ায় ভোট দেন মিশেল ও ম্যাথিউ নিলসেন। ভোটে প্রার্থী বাছাইয়ে অর্থনৈতিক উদ্বেগ তাঁদের প্রভাবিত করেনি। তাঁরা গর্ভপাত অধিকারের সুরক্ষা চেয়েছেন। থামাতে চেয়েছেন রিপাবলিকান সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুগত প্রার্থীদের।আলফারেটায় ভোটকেন্দ্রের বাইরে ৩৩ বছর বয়সী ম্যাথিউ নিলসেন বলেন, ‘কেউ যদি চান আমি রিপাবলিকানদের ভোট দিই, তাতে আপত্তি নেই। তবে তাঁরা যেন সম্ভব হলে গর্ভপাত এবং ট্রাম্পের কথা বলে ভোট না চান।’

অতীতে এই দম্পতির একজন ডেমোক্র্যাট আর অন্যজন রিপাবলিকানদের সমর্থন করতেন। কিন্তু এবার তাঁরা দুজনই ডেমোক্র্যাট সিনেটর প্রার্থী রাফায়েল ওয়ারনককে ভোট দিয়েছেন।
ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া লাখো ভোটারের উদ্বেগটাই তাঁরা বলেছেন। এই সমর্থকদের সংখ্যা বিস্মিত হওয়ার মতো। নির্বাচনে রিপাবলিকানরা কথিত ‘লাল ঢেউয়ের’ যে প্রত্যাশা করেছিলেন, তা ঠেকিয়ে দিয়েছেন এসব ভোটাররাই।

আরও পড়ুন

বিশ্বের জনসংখ্যা ৮০০ কোটি হবে ১৫ নভেম্বর

গতকাল বুধবার ফলাফল আসার পর থেকেই সেই ঢেউ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। তবে রিপাবলিকানরা প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পথেই রয়েছেন। আগে থেকেই এমনটি ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যবধান হবে ধারণার চেয়ে আরও কম। কারা সিনেটের নিয়ন্ত্রণ পাবেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এ জন্য সম্ভবত জর্জিয়ায় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে দ্বিতীয় ধাপের ভোটাভুটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে।

রিপাবলিকানরা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অজনপ্রিয়তা এবং খাবার ও গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমেরিকানদের ক্ষোভ তাঁদেরকে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে সাহায্য করবে।

বুথফেরত জরিপ বিশ্লেষকদের সাক্ষাৎকার এবং ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে দেখা যায়, মূল্যস্ফীতির বিষয়টি ভোটারদের জন্য প্রধানতম বিবেচ্য বিষয় ছিল। একই সঙ্গে গর্ভপাত অধিকার সুরক্ষার বিষয়টিও সর্বোচ্চ বিবেচনার কাছাকাছিই ছিল তাঁদের।

এই বিষয় ডেমোক্রেটিক পার্টির কৌশলবিদ এবং জরিপ সংস্থাগুলোকে বিস্মিত করেছে। তাদের ধারণা ছিল, গর্ভপাত অধিকার হারানোর উদ্বেগসহ সবকিছুকে ছাড়িয়ে যাবে মূল্যস্ফীতি ইস্যু। তারা মূল্যস্ফীতির বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আরও বেশি সময় দিতে দলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।

এমনকি প্রচারণার শেষের দিনগুলোয় হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তাদের উদ্বেগ ছিল, তাঁরা গর্ভপাতের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে অনেক বেশি সময় ব্যয় করেছেন আর জিনিসপত্রের উচ্চ মূল্যের বিষয়ে খুব কম সময় দিয়েছেন। জাতীয় জনমত জরিপ এই ধারণাকে আরও পোক্ত করেছিল। এসব জরিপে দেখা যায়, ভোটাররা মূল্যস্ফীতি নিয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন।

ভোটাররা রয়টার্সকে এ-ও বলেন, রিপাবলিকান পার্টির ক্রমাগত ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কাছে টানার বিষয়টি নিয়ে তাঁরা উদ্বিগ্ন। তিনি আগামী সপ্তাহে আরেক মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

এডিসন রিসার্চের বুথফেরত জরিপ অনুযায়ী, ট্রাম্প সম্পর্কে ৫৮ শতাংশ ভোটারই নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। বিপরীতে তাঁর সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন ৩৯ শতাংশ ভোটার।

ব্যালটে গর্ভপাত ইস্যু

গত জুনে যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক গর্ভপাত অধিকার–সংশ্লিষ্ট আইন বাতিল করে দেন সুপ্রিম কোর্ট। এতে ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থন শক্তিশালী হয়। বিপুলসংখ্যক ভোটার নিবন্ধিত হতে থাকেন। কিছু নিরপেক্ষ ভোটার ডেমোক্রেটিক প্রার্থীদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।

ডেমোক্রেটিক পার্টির সিনেট ও গভর্নর পর্যায়ে রাজনীতি করে আসছেন জারেড লিওপোল্ড। তিনি বলেন, কোন দলটির প্রতি ক্ষোভ বেশি, সেটাই মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফল ঠিক করে দেয়। যার কারণে সাধারণত প্রেসিডেন্টের দল হেরে যায়। কিন্তু গর্ভপাত ইস্যু সেই গতিধারাকে কঠিন করে দিয়েছে।

ঐতিহাসিকভাবে নিরপেক্ষ ভোটাররা মধ্যবর্তী নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে থাকেন। কিন্তু এডিসনের বুথফেরত জরিপে দেখা যায়, নিরপেক্ষ ভোটাররা রিপাবলিকানদের চেয়ে ডেমোক্র্যাটদের ৪৯ থেকে ৪৭ শতাংশ ব্যবধানে ভোট দিয়েছেন। এই পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নারী ভোটাররা ভূমিকা রেখেছেন।

সার্বিকভাবে ৩১ শতাংশ ভোটার বলেছেন, তাঁদের প্রধান উদ্বেগ মূল্যস্ফীতি। ২৭ শতাংশ ভোটার বলেছেন, গর্ভপাত তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড় ইস্যু। আর প্রতি ১০ জনের একজন অপরাধ এবং অভিবাসনকে উদ্বেগের বিষয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

কিন্তু জরিপে নারীদের মধ্যে মূল্যস্ফীতির চেয়ে গর্ভপাতের বিষয়টি ৫ পয়েন্ট বেশি এগিয়ে ছিল। চলতি বছর পুরুষদের চেয়ে নারী ভোটারের সংখ্যা কিছুটা বেশি ছিল।

অঙ্গরাজ্যের ভোটেও গর্ভপাত ইস্যুটি প্রাধান্য পেয়েছে। মিশিগানের ভোটাররা গর্ভপাত অধিকারের সাংবিধানিক সুরক্ষার পক্ষে রায় দেন। তাঁরা গ্রেচেন হুইটমারকে পুনরায় গভর্নর নির্বাচিত করেন। তিনি গর্ভপাত অধিকার সুরক্ষায় ‘সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে লড়াইয়ের’ অঙ্গীকার করেছেন। অন্যদিকে অঙ্গরাজ্যের সংবিধান থেকে গর্ভপাত অধিকার বাদ দেওয়ার ব্যালট ছিল কেন্টাকিতে। ভোটাররা এর বিপক্ষে রায় দেন।

গর্ভপাত অধিকার ইস্যুতে কিছু ভোটার দলীয় অবস্থান থেকে সরে আসেন। ইউনিভার্সিটি অব নেভাদার ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থী সিডনি রাইট নিজেকে রক্ষণশীল বলেই বিবেচনা করেন। কিন্তু তিনি গর্ভপাত ইস্যুর কারণে ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ভোট দিয়েছেন। এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি বরং এই নির্বাচনে সামাজিক বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়েছি।’

ট্রাম্প ফ্যাক্টর

রাইট আরও বলেন, গর্ভপাত ইস্যুতে ট্রাম্পের অবস্থান এবং বিতর্কিত আচরণের কারণে তাঁর ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনি। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রিপাবলিকান পার্টি ট্রাম্পকে মনোনয়ন দেবে না বলেও আশা করছেন এই শিক্ষার্থী।

অ্যারিজোনার ফোনিক্সে রিপাবলিকান হিসেবেই নিবন্ধিত ৩৭ বছর বয়সী নিয়াশা রিলি। কিন্তু গর্ভপাত অধিকার ইস্যুতে তিনিও রাইটের মতো ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে, রিপাবলিকানরা খুব বেশি ডানপন্থী হয়ে উঠেছেন।

পেনসিলভানিয়ার একজন জ্যেষ্ঠ রিপাবলিকান কর্মকর্তা বলেছেন, রিপাবলিকান মেহমেত ওজের বিরুদ্ধে ডেমোক্র্যাট জন ফেটারম্যানের সিনেটের আসনে জয় অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকানদের নতুন করে চিন্তা-ভাবনার দিকে নিয়ে যাবে।

রিপাবলিকান কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘একটি বিষয় আমরা শিখতে পেরেছি, পেনসিলভানিয়ার মতো তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অঙ্গরাজ্যে (সুইং স্টেট) জয় পাওয়াটা ট্রাম্প-সমর্থিত প্রার্থী আরও কঠিন করে তুলেছেন। এমন মুহূর্তটির জন্য এই রাজ্য ঠিকই ট্রাম্পের ওপর বিরক্ত।’

পেনসিলভানিয়ার মনরো কাউন্টির অবসরপ্রাপ্ত ওষুধ ও অ্যালকোহল বিশেষজ্ঞ জোনাহ টালবাট। ৬৫ বছর বয়সী এই মার্কিন অতীতে রিপাবলিকানদের ভোট দিয়েছেন। তিনি বলেন, ২০২০ সালের নির্বাচন নিয়ে ট্রাম্পের ভুয়া দাবির পক্ষে দাঁড়ানো রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে লড়তে তিনি স্থানীয় ও অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে রাজনীতিতে আরও বেশি সক্রিয় হচ্ছেন। জোনাহ বলেন, অর্থনীতির চেয়ে তাঁর কাছে এ বিষয় আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সূত্র-প্রথম আলো

আরও পড়ুন

ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লুলার জয়

যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরবের সম্পর্ক এখনো অবিচ্ছেদ্য

ভারতের প্রধান তেল সরবরাহকারী দেশ এখন রাশিয়া- ইকোনোমিক টাইমস