যুক্তরাষ্ট্রে চিপ শিল্পে বিনিয়োগ কমিয়ে বা পিছিয়ে নেবে স্থানীয় ও এশীয় চিপ নির্মাতা কোম্পানিগুলো। ওয়াশিংটনের প্রস্তাবিত ৫ হাজার ২০০ কোটি ডলারের চিপস অ্যাক্ট বাস্তবায়নে গড়িমসিতে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। বৈশ্বিক চিপ স্বল্পতা ও চীনের সঙ্গে তিক্ততা বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে চিপ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পরিকল্পনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হচ্ছিল।

 কিন্তু প্রস্তাবিত বিল কার্যকরে বিলম্ভের ফলে স্থানীয় ও এশীয় সেমিকন্ডাক্টর কোম্পানিগুলো কার্যক্রম সীমিত করছে বা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা গুটিয়ে নিচ্ছে।

সম্প্রতি এক ঘোষণায় ওহাইওতে ২ হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে কারখানা স্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটার কথা জানায় ইন্টেল। জিডিনেটকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে ইন্টেলের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে ওহাইওতে আধুনিক প্রযুক্তিসংবলিত কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে না। মূলত চিপ উৎপাদনসংক্রান্ত আইন এখনো বাস্তবায়ন না হওয়ায় এ সিদ্ধান্ত।

এক বিবৃতিতে মার্কিন চিপ নির্মাতা কোম্পানিটি জানায়, চিপ উৎপাদন আইন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আমাদের প্রত্যাশার তুলনায় ধীরগতিতে এগোচ্ছে। সেই সঙ্গে কবে নাগাদ এটি সম্পন্ন হবে সেটিও পরিষ্কার নয়। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, চিপ উৎপাদনের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ অবস্থান ফিরিয়ে আনতে এবং স্থিতিশীল সরবরাহ চেইন তৈরিতে আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছি তা বাস্তবায়নে কংগ্রেসকে পদক্ষেপ নিতে হবে।

বিশ্বজুড়ে চলমান চিপ সংকটের মধ্যে জানুয়ারিতে ইন্টেল আরো ২ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন দুটি কারখানা স্থাপনের কথা জানিয়েছিল। ইন্টেলের পাশাপাশি বিনিয়োগ সংকোচনের ঘোষণা দিয়েছে অন্য মার্কিন কোম্পানি গ্লোবালফাউন্ড্রিজ। বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ এ চুক্তিভিত্তিক চিপ নির্মাতা কোম্পানিটি জানায়, চিপস অ্যাক্টের ভবিষ্যতের ওপর নির্ভর করবে তারা যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াবে কিনা। নিউইয়র্কে একটি কারখানা স্থাপনে ১০০ কোটি ডলার ব্যয়ের পরিকল্পনা রয়েছে গ্লোবালফাউন্ড্রিজের।

এশীয় চিপ নির্মাতা জায়ান্টগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে চিপস অ্যাক্টের বাস্তবায়ন তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় কোম্পানির পাশাপাশি বিদেশী কোম্পানিগুলোকে কর রেয়াত ও অন্যান্য প্রণোদনা দিলে তারা যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা স্থাপনে এগিয়ে আসবে। যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ পরিচালন ব্যয় ও প্রকৌশলী স্বল্পতার কারণে বুঝেশুনে এগোনোর পক্ষপাতী টিএসএমসির মতো চিপ নির্মাতা জায়ান্ট।

স্থানীয় চিপ নির্মাতা কোম্পানির কার্যক্রম সম্প্রসারণে ভর্তুকির জন্য প্রস্তাবিত বিলটি প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে পাস হয়েছিল। প্রতিনিধি পরিষদে ২২২-২১০ ভোটে অনুমোদন পেয়েছিল চিপস অ্যাক্টটি। গত জুনের প্রথম দিকে ৬৮-৩২ ভোটে উচ্চকক্ষ সিনেটে অনুমোদন পায় বিলটি। চায়না কম্পিটিশন বিল হিসেবে পরিচিত বিলটি আইনে পরিণত হলে কর অব্যাহতিসহ অন্যান্য প্রণোদনা পাবে যুক্তরাষ্ট্রের সেমিকন্ডাক্টর শিল্প। কিন্তু বিলটি অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত অবস্থায়। এদিকে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও সরবরাহ চেইন সংকটে বিনিয়োগে বেশ হিসাব করে এগোচ্ছে চিপ নির্মাতা জায়ান্টগুলো। ইন্টেল ও টিএসএমসির মতো কোম্পানিগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে সম্প্রসারণ পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসছে।

গত ২৭ জুন টেক্সাসে কারখানা স্থাপনে ৫০০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিল তাইওয়ানভিত্তিক গ্লোবালওয়েফার্স। কিন্তু সম্প্রতি বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ এ সিলিকন ওয়েফার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি এ ইঙ্গিত দেয়, কারখানা বাস্তবে রূপ পেতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রণোদনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্লোবালওয়েফার্সের চেয়ারম্যান ও সিইও ডরিস হু নিক্কেই এশিয়াকে বলেন, আমাদের সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ চিপস অ্যাক্টের দিকে। শিগগিরই চিপস অ্যাক্ট পাস না হলে আমরা বিনিয়োগ পরিকল্পনা সমন্বয় করব।

যুক্তরাষ্ট্রের সেমিকন্ডাক্টর খাতে স্বনির্ভরতায় চিপস অ্যাক্ট পাস যে গুরুত্বপূর্ণ এ কথা স্বীকার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যমন্ত্রী জিনা রাইমন্ডো। তিনি বলেন, চিপ নির্মাতা কোম্পানিগুলো যে বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে তা আসলে কংগ্রেসের চিপস অ্যাক্ট পাসের ওপর নির্ভরশীল। 

সম্প্রতি বিশ্বের শীর্ষ চিপ নির্মাতা কোম্পানি টিএসএমসির বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তে সতর্ক অবস্থানের প্রমাণ পাওয়া যায়। জুনের শুরুতে তাইওয়ানভিত্তিক সেমিকন্ডাক্টর জায়ান্টটি জানায়, ইউরোপে নিকট ভবিষ্যতে কারখানা চালুর পরিকল্পনা নেই তাদের। শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে বার্ষিক এক সভায় টিএসএমসি চেয়ারম্যান মার্ক লিয়ু বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনায় নির্মাণ হতে যাওয়া বিদেশে তাদের প্রথম কারখানার নির্মাণ ব্যয় প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। তবে ব্যয় ঠিক কী পরিমাণ বেশি হচ্ছে, এ তথ্য শেয়ার করেননি তিনি। স্থানীয় কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি বিদেশী চিপ নির্মাতা কোম্পানিগুলোকেও প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ওয়াশিংটনের সহায়তা করা উচিত বলে মনে করেন লিয়ু।

টিএসএমসি চেয়ারম্যান আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ান নিয়োগ দেয়া তাইওয়ানের চেয়ে অনেক কঠিন। তবে প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আরিজোনা কারখানার জন্য কর্মী নিয়োগ চলছে। নতুন কোনো জায়গায় কারখানা স্থাপনের শুরুতে কর্মী সংকটে পড়তে হয়। তাইওয়ানের তুলনায় সে জায়গায় কম চিপ কারখানা রয়েছে এবং সরবরাহ চেইন পরিপূর্ণ নয়। ইউরোপে চিপ কারখানা স্থাপন নিয়ে লিয়ু বলেন, নিকট ভবিষ্যতে আপাতত কারখানা নির্মাণের পরিকল্পনা নেই টিএসএমসির।

১৯৯০-এর দশকের শুরুতে বৈশ্বিক চিপ বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হিস্যা ছিল ৩৭ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তা ১২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বৈশ্বিক চিপ উৎপাদনের ৭৫ শতাংশ হিস্যা এখন পূর্ব এশিয়ার। সবচেয়ে অগ্রসর চিপের ৯০ শতাংশ তৈরি হচ্ছে তাইওয়ানে। করোনা পরিস্থিতিতে সরবরাহ চেইন সংকট এবং তাইওয়ান নিয়ে চীনের পলিসি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই চিপ নির্মাণে সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছেন।

সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্সের মতো কিছু রাজনীতিবিদ অবশ্য চিপ নির্মাতা কোম্পানিকে ভর্তুকির বিরোধিতা করছেন। তাদের যুক্তি সেমিকন্ডাক্টর শিল্প এমনিতেই বেশ লাভজনক। সেখানে রাষ্ট্রীয় সহায়তার প্রয়োজন নেই। এদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী রাইমন্ডোর মতে, এশিয়ার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে সেমিকন্ডাক্টর কারখানা স্থাপন অনেক ব্যয়বহুল। যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা স্থাপনে চিপ নির্মাতাদের আকর্ষণ করতে চাইলে তাদের ভর্তুকি দিতে হবে। চিপ সংকট এখন শুধু অর্থনৈতিক ইস্যু নয়, বরং এটা জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু। সামরিক উপকরণ, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) অ্যাপ্লিকেশনের জন্য হাই-টেক চিপ প্রয়োজনীয়।