Spoken+Grammar Bundle

দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিজ্ঞানাগার নেই ৬ হাজার ২৩৫ টি বিদ্যালয়ে। যা দেশের সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ২০ হাজার ৯৬০টি বিদ্যালয়ের ২৯.৭৫ শতাংশ। ফলে দেশের মাধ্যমিক স্তরেই বিজ্ঞান বিষয়ে হাতে-কলমে না শিখে পরবর্তী শিক্ষাস্তরে প্রবেশ করছে দেশের ৩০ লাখ ৩১ হাজার ৫৩১ জন শিক্ষার্থী। বর্তমানে দেশের মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করছে মোট ১ কোটি ১ লাখ ৯০ হাজার ২২ জন শিক্ষার্থী। আর এ বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পৌঁছে দেবার দায়িত্বে আছেন মোট ২ লাখ ৬৬ হাজার ৫৬৮ জন শিক্ষাগুরু।


এসব তথ্য জানানো হয়েছে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) এর বার্ষিক প্রতিবেদনে। তাদের তথ্য বলছে, দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বিজ্ঞানাগার রয়েছে ৭১ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে। ফলে, দেশের মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে হাতে-কলমে বিজ্ঞান শেখার সুযোগ থেকে এবং বিজ্ঞানের নানা জটিল বিষয়ের মৌলিক বিষয়াদি সম্পর্কে ধারণা না নিয়েই শুরু হয় তাদরে পরবর্তী শিক্ষা-জীবন। যাতে তারা পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষায় ও চাকুরীর ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকেন অন্য শিক্ষার্থীদের তুলনায়।


ব্যানবেইস এর প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়েছে, গত একবছরে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানাগার বেড়েছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ। যা ২০২০ সালে ছিল ৭০ দশমিক ১৮ শতাংশ। এর আগের বছরগুলোতে যা ছিল যথাক্রমে ২০১৯ সালে ৬৮ দশমিক ৩ শতাংশ ও ২০১৮ সালে যা ছিল ৫৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সে হিসেবে দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাড়ছে বিজ্ঞানাগারের সংখ্যা। কিন্তু, একটি বিজ্ঞানমনষ্ক জাতি গঠনে বাধা হিসেবে কাজ করছে একটি বড় সংখ্যক প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানাগার না থাকা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।


তারা বলছেন, তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞান দুটোই সমান অপরিহার্য বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে। শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের মাধ্যমে তত্ত্বীয় বিষয়গুলো পড়ানো হলেও বিজ্ঞানাগার না থাকলে কোনোভাবেই পড়ানো বা শেখানো সম্ভব নয় ব্যবহারিক বিষয়গুলো। আর, দেশের ২৯.৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সে জ্ঞান অর্জন ছাড়াই পাশ করছে এবং উচ্চশিক্ষার জন্য আসছে। যার প্রভাব তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে পড়বে বলে আশংকা তাদের।
ব্যানবেইসের প্রকাশিত বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিস্টিকস ২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মাধ্যমিক পর্যায়ে (নবম ও দশম) বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করছে এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০ লাখ ৯৯ হাজার ৪শত ৭৯ জন। কিন্তু বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানাগার না থাকায় তাদের একটি বড় অংশই বিজ্ঞান বিষয়ে ব্যবহারিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।


দেশের বিজ্ঞান শিক্ষার দুরবস্থা কথা উঠে এসেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের এক গবেষণায়ও। সংস্থাটির এক প্রতিবেদন বলছে, শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক জ্ঞানের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে ব্যবহারিক ক্লাসে তাদের সুযোগ না দেবার ফলে। তাদের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিজ্ঞানাগার থাকলেও তাতে ব্যবহারিক ক্লাস হয়না ৬১ দশমিক ৭ শতাংশ ক্ষেত্রে। আর ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, তাদের বিজ্ঞানাগারে ক্লাস করতে পরিশোধ করতে হয় অতিরিক্ত ফি।


যদিও জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং গাণিতিক যুক্তি প্রয়োগের মধ্য দিয়ে প্রকৃতির রহস্যকে উন্মোচনের জন্য শিক্ষার্থীদের এমনভাবে প্রস্তুত করা হবে; যাতে তাদের প্রতিভা বিকাশ, জ্ঞান সাধনা এবং সৃজনশীলতায় তারা আন্তর্জাতিক মান অর্জন করতে পারে। আর সেজন্য শিক্ষানীতিতে জোর দেওয়া হয়েছিল হাতে-কলমে তথা ব্যবহারিক শিক্ষাকে। কিন্তু, বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানাগার না থাকায় তাদের একটি বড় অংশই বিজ্ঞান বিষয়ে ব্যবহারিক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যা বাড়াচ্ছে শিক্ষায় বৈষম্য।


মূলত, আমাদের এসএসসির মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণেই আমরা বিজ্ঞান শিক্ষাকে হাতে-কলমে শেখাতে পারছি না বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বর্তমানে এসএসসির ব্যবহারিক পরিক্ষা অনেকটাই আনুষ্ঠানিকতা। তিনি তার একটি গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে বলেন, মাত্র ২ ঘণ্টায় ৭০০ শিক্ষার্থীর ব্যবহারিক পরিক্ষা গ্রহণ শেষ হয়। এতে শিক্ষার্থীদের কোনরকম মূল্যায়ন না করেই তাকে ২৫ মার্ক দেয়া হয়। যার ফলে শিক্ষার্থী যেহেতু না পড়ে, না শিখে, ব্যবহারিক না করেই ফলাফল পাচ্ছে এতে শেখার জন্য নূন্যতম আগ্রহও তৈরি হচ্ছে না।


একইসাথে তিনি বলেন, এসএসসির এমন ত্রুটিপূর্ণ মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণে প্রথমত, আমাদের শিক্ষকরাই আগ্রহী না শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান তত্ত্বের পাশাপাশি তাদের হাতে-কলমে শেখানোর বিষয়ে। দ্বিতীয়ত, আমাদের শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, যেহেতু সহজেই মার্ক বা ফলাফল পাওয়া যায় অতএব এ খাতে বিনিয়োগ করাটা অনেকটাই অপচয়। তৃতীয়ত, শিক্ষকদের অদক্ষতা রয়েছে; পাশাপাশি তারা ল্যাব ক্লাস না করে অন্য বিষয় যেমন: বাংলা, ইংরেজি কিংবা গণিত ক্লাস করাতে বেশি আগ্রহী। তিনি বলেন, এটি একদম সহজ কথায় আমাদের প্রচলিত মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণেই হয়েছে।
অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, বিজ্ঞান শিক্ষাকে হাতে-কলমে শিক্ষার্থীদের শেখানোর জন্য আমাদের প্রচলিত মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন করতে হবে। তিনি জানান, মূল্যায়ন পদ্ধতির পরিবর্তন অর্থাৎ যখন একজন শিক্ষার্থী ব্যবহারিক না করে বা না শিখে যখন আর ফলাফল পাবে না তখন সে বাধ্য হয়েই শিখবে। এতে শিক্ষকরা আগ্রহী হবে শিক্ষার্থীদের শেখাতে; অভিভাবকরাও আগ্রহী হবে এসব বিষয়ে- যুক্ত করেন অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান।


এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলিকুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিজ্ঞান শিক্ষায় হাতেকলমে শেখানোর ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানাগার থাকাটা অপরিহার্য। আমাদের কাছে বিভিন্ন বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানাগার না থাকার বিষয়টি একটি বড় সীমাবদ্ধতা। একইসঙ্গে বিজ্ঞানাগার আছে কিন্তু যন্ত্রপাতি ও উপকরণ নেই। এ সমস্যারও সমাধান করা দরকার।


ড. কাজী খলিকুজ্জামান মনে করেন, এতে শিক্ষায় বৈষম্য তৈরি হচ্ছে; পাশাপাশি প্রচলিত শিক্ষায় সমান সুবিধা না পাওয়া একজন শিক্ষার্থী শিক্ষিত হতে পারছে না পরিপূর্ণভাবে। তিনি বলেন, আমরা প্রচলিত শিক্ষায় প্রয়োজনভিত্তিক দক্ষ জনবল তৈরি করতে পারছি না। একজন শিক্ষার্থী কোনও কিছু না শিখতে পারলে সে অদক্ষ হয়ে বা না শিখে বড় হবে। যার প্রভাব তার পরবর্তী জীবন ও কর্মে পড়বে। এতে দেশের আগামীর অর্থনীতিতে যার প্রভাব পড়বে। তিনি বলেন, দক্ষ জনবল না থাকলে তো আপনি কাজ করতে পারবেন না।


তিনি দেশের বেসরকারি খাতের উদাহরণ দিয়ে বলেন, আমাদের দক্ষ জনবলের অভাবের সুযোগ নিয়ে পার্শ্ববর্তী ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশ আমাদের দেশ থেকে প্রায় ৫-৬ বিলিয়ন ডলার আয় করছে। সেজন্য এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন শিক্ষা এবং দক্ষতার সম্মিলন ঘটাতে হবে। সেজন্য দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা বিশেষকরে বিজ্ঞান শিক্ষায় হাতেকলমে শিখিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে বলেও জানান ড. কাজী খলিকুজ্জামান।
Source-the daily campus

আরও পড়ুন

ডেনমার্কের সেরা ছয় বিশ্ববিদ্যালয়

উঠে যাচ্ছে জিপিএভিত্তিক ফল, থাকছে না কাঠামোবদ্ধ প্রশ্ন

গণিত ও ইংরেজি শিক্ষকের ৮০ শতাংশই ভিন্ন বিষয়ে ডিগ্রিধারী