‘তরুণেরা সরকারি যেকোনো চাকরির প্রতি বেশি আগ্রহ দেখান। সরকারি চাকরির যে বিজ্ঞাপনগুলো আমাদের ওয়েবসাইটে থাকে, তাতে বেশি ক্লিক করা হয়।’ কথাগুলো বলছিলেন এম কে এম ফাহিম মাশরুর, যিনি দেশের চাকরি খোঁজার শীর্ষস্থানীয় ওয়েব পোর্টাল বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। তাঁর দাবি, তাঁদের ওয়েবসাইটে চাকরি খোঁজা ব্যক্তিদের বড় অংশ তরুণ। তাঁরা নতুন চাকরি খুঁজছেন।

সরকারি চাকরির প্রতি তরুণদের ঝোঁক নতুন নয়। তবে জবসাইটের মতো আধুনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে চাকরি খোঁজা তরুণেরা কোন ধরনের চাকরির প্রতি আগ্রহ দেখান, তা জানতে কথা হয় চাকরিসংক্রান্ত দুটি ওয়েব পোর্টালের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে। তাঁরা জানান, তরুণদের আগ্রহ বেশি আসলে সরকারি চাকরির প্রতি। এর বাইরে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) প্রতিষ্ঠানে চাকরি খোঁজার হার এখন বেশি।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও বিশ্বব্যাংকের গবেষণা বলছে, দেশে প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখের বেশি নতুন মুখ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে, যেখানে মোট কর্মসংস্থানের মাত্র ৫ শতাংশ সরকারি খাতে রয়েছে। আর ৯৫ শতাংশ কর্মসংস্থানের উৎস বেসরকারি খাত।

শিক্ষিত তরুণদের মধ্যেই বেকারত্বের হার বেশি। সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, ওই সময় ১০ লাখ ৪৩ হাজার তরুণ-তরুণী উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেও বেকার ছিলেন। বেকারদের মধ্যে ৩৯ শতাংশই শিক্ষিত। অনেকেই বছরের পর বছর ধরে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিতে থাকেন। কেউ কেউ পান, কেউ কেউ পান না।

বিডিজবস কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের পোর্টালে প্রায় ৪০ লাখ চাকরিপ্রার্থীর জীবনবৃত্তান্ত (সিভি) রয়েছে। চাকরিপ্রার্থীরা জীবনবৃত্তান্ত ওয়েবসাইটে দেওয়ার সময় কোন চাকরি পছন্দ করেন, তা উল্লেখ করতে পারেন। সেই তালিকা পর্যবেক্ষণ করে বিডিজবস কর্তৃপক্ষ বলছে, যাঁরা নতুন চাকরিপ্রার্থী, তাঁদের বেশির ভাগ প্রথম পছন্দ দিয়েছেন সরকারি চাকরি। এরপর তাঁদের পছন্দের তালিকায় আছে সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের চাকরি। এ ছাড়া আইটি প্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরিও রয়েছে তরুণদের পছন্দের তালিকায়।

চাকরিবিষয়ক আরেক ওয়েবসাইট এনআরবি জবস কর্তৃপক্ষ জানায়, সেখানে সাড়ে তিন লাখ চাকরিপ্রার্থীর জীবনবৃত্তান্ত রয়েছে। বেশির ভাগ তরুণ সরকারি ও ব্যাংকের চাকরিকে প্রথম পছন্দ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এরপর রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিপণন ও বিক্রয় বিভাগ (মার্কেটিং ও সেলস) ও আইটিবিষয়ক চাকরি।

তরুণদের আগ্রহের বিষয়ে আরও কিছু তথ্য দেন এনআরবি জবসের হেড অব বিজনেস মুশফিকুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আইটি ও মানবসম্পদ বিভাগের চাকরিতেও তরুণদের আগ্রহ আছে। তাঁদের অনেকে আইটি বিষয়ে পড়েছেন। তাঁরা সংখ্যায় কম নন। তাই এ বিষয়ে যত চাকরি আছে, তাতে তরুণদের আগ্রহ দেখা যায়।

মুশফিকুর রহমান আরও বলেন, মার্কেটিং ও সেলসে চাকরির অনেক বিজ্ঞাপন থাকে। এতেও তরুণদের একটি বড় অংশ আবেদন করে।

ব্যাংকে শুরুতেই বেতন ‘আকর্ষণীয়’

বিডিজবসের ফাহিম মাশরুর মনে করেন, সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের চাকরিতে তরুণদের বেশি আগ্রহ থাকার একটি কারণ, সেখানে শুরুতেই ভালো বেতনে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর নিয়োগের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় না। তিনি বলেন, বিশেষ করে সরকারি ব্যাংকের অফিসার, সিনিয়র অফিসার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক এবং বেসরকারি ব্যাংকের ‘ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার’–এর পদগুলো বেশি জনপ্রিয়।

২০১৮ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংকে ৭ হাজারের বেশি কর্মকর্তা নিয়োগের সিদ্ধান্ত হয়। তখন আবেদন করেছিলেন প্রায় ১১ লাখ প্রার্থী। একটি পদের বিপরীতে গড়ে ১৫৭টি আবেদন জমা পড়ে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে নিয়োগসংক্রান্ত কর্তৃপক্ষ ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি (বিএসসি) তখন বলেছিল, ব্যাংকে নিয়োগের ক্ষেত্রে এর আগে একসঙ্গে এত আবেদন জমা পড়েনি।

ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির মার্কেটিং বিভাগ থেকে পাস করা শরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চাকরি খোঁজার ক্ষেত্রে তিনি প্রথমে বেছে নেন ব্যাংকের চাকরি। ব্যাংকের ওয়েবসাইটে গিয়ে খুঁজে থাকেন নতুন বিজ্ঞাপন আছে কি না। জব পোর্টালে তিনি এ পর্যন্ত ১৫টি প্রতিষ্ঠানে আবেদন করেছেন। ডাক পেয়েছেন ৪টিতে। কিন্তু এখনো চাকরি হয়নি তাঁর।

সরকারি চাকরিতে আগ্রহের কারণ কী

সাম্প্রতিক কালে বিসিএসের প্রতি তরুণদের আগ্রহ ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) হিসাব বলছে, ২০০৮ সালে ২৮তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল সোয়া লাখের কিছু কম। সর্বশেষ ৪৪তম বিসিএসে (২০২১) তা চার লাখে উন্নীত হয়।

সরকারি চাকরিতে যে তরুণদের আগ্রহ বেশি, তা উঠে এসেছে গবেষণায়ও। ২০১৮ সালের আগস্টে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে এক যুব-জরিপ চালিয়েছিল। জরিপে দেখা গেছে, শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ নারী এবং ৪২ শতাংশ পুরুষ সরকারি চাকরিকে নিজেদের প্রথম পছন্দে রেখেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে পাস করা সাব্বির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিসিএসসহ যেকোনো সরকারি চাকরি ও ব্যাংকের চাকরিতে তাঁর আগ্রহ বেশি। তবে যোগ্যতায় মিললে অন্য চাকরিও তিনি খোঁজেন।

বিসিএসের বাইরে অন্য সরকারি চাকরিতেও বিপুলসংখ্যক আবেদন জমা পড়ে। যেমন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ১২টি পদের বিপরীতে ২৪২ জন কর্মী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল ২০২০ সালে। এতে প্রতিটি পদের বিপরীতে গড়ে ৯০০টি করে আবেদন জমা পড়ে। উপপরিদর্শকের (এসআই) পদ ছিল নয়টি। এর মধ্যে একেকটি পদের বিপরীতে গড়ে সাড়ে আট হাজার তরুণ আবেদন করেছিলেন।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি চাকরিতে বেশি আগ্রহের কারণ এখনকার ভালো বেতন, সুযোগ-সুবিধা ও নিশ্চিত জীবন। করোনাকালে বেসরকারি খাতে ছাঁটাই হয়েছে, অনেক প্রতিষ্ঠান বেতন-ভাতা কমিয়েছে, বিপরীতে সরকারি চাকরিতে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধায় কাটছাঁট হয়নি; বরং এখন পদোন্নতি পেয়ে একটা পর্যায়ে গাড়ি ও ফ্ল্যাট কেনার ঋণও পাওয়া যায়।

সরকারি চাকরিতে কেন এত আগ্রহ, তা জানতে চাইলে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সাবেক প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মোশাররফ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৫ সালে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বেতনকাঠামো পুনর্গঠন হয়। তখন বেতন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা আর অবসর ভাতাও এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি আরও বলেন, সরকারি চাকরিতে চাকরির নিরাপত্তাও তরুণদের আগ্রহের একটি বড় কারণ।

আরও পড়ুন

পাঠশালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়

একজনের বিপরীতে দেড় লাখ মশা

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো আছে কি না বুঝবেন যেভাবে