আল-জাজিরার রিপোর্ট

 

কায়রোতে বসবাসের খরচ এতটাই বেড়ে গেছে যে, নিরাপত্তারক্ষী মোস্তফা গামাল তার স্ত্রী এবং এক বছর বয়সী মেয়েকে ৭০ মাইল (১১২ কিমি) দক্ষিণে একটি গ্রামে তার বাবা-মায়ের সাথে থাকতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ২৮ বছর বয়স্ক গামাল এখন কায়রোতে একাই থাকেন এবং দুইটি চাকরি করেন। তাকে অন্যদের সঙ্গে একটি ফ্লাট ভাগাভাগি করে থাকতে হয়। সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় তার খাদ্য তালিকা থেকে মাংস বাদ পড়েছে। তিনি জানান, সবকিছুর দাম দ্বিগুণ করা হয়েছে। এসবের কোন বিকল্প ছিল না।
বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের অবস্থা এখন গামালের মতো। কেনিয়ার নাইরোবিতে একজন অটো-পার্টস ডিলার, তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বাচ্চাদের কাপড়ের বিক্রেতা এবং বৃটেনের ম্যানচেস্টারের একটি ওয়াইন আমদানিকারকের কষ্ট এখন একই জায়গায়। এই তিনজনেরই অভিযোগ, মার্কিন ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় তাদের স্থানীয় মুদ্রা দুর্বল হয়ে গেছে। এতে করে দৈনন্দিন পণ্য এবং পরিষেবার ব্যয় আকাশ ছুঁয়েছে। 

ডলার শক্তিশালী হওয়ায় বিশ্ব এখন নতুন এক সংকটের মুখে রয়েছে। এমনিতেই ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের কারণে বিশ্বে খাদ্য ও জ্বালানির দাম বেড়েছে।

তারমধ্যে ডলার শক্তিশালী হয়ে যাওয়া এখন নতুন এক উদ্বেগের বিষয়। কর্নেল ইউনিভার্সিটির ট্রেড পলিসির অধ্যাপক এশ্বর প্রসাদ বলেন, একটি শক্তিশালী ডলার বিশ্বের বাকি অংশে একটি খারাপ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তোলে। অনেক অর্থনীতিবিদ উদ্বিগ্ন যে, ডলারের এই মাত্রাতিরিক্ত উত্থান আগামী বছর বিশ্বব্যাপী মন্দা সৃষ্টি করতে পারে। 
এই বছর ডলারের দাম ১৮ শতাংশ বেড়েছে এবং গত মাসে ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ডলারের ঊর্ধ্বগতির কারণ যদিও কোন রহস্য নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি মোকাবেলায় দেশটির ফেডারেল রিজার্ভ এই বছর পাঁচবার স্বল্পমেয়াদী সুদের হার বাড়িয়েছে এবং সামনেও আরও বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিয়েছে। এর ফলে বিনিয়োগকারীরা প্রলুব্ধ হয়ে মার্কিন মুদ্রায় বিনিয়োগ করছে। কিন্তু এর প্রভাবে অন্য মুদ্রাগুলোর দাম পড়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে দরিদ্র দেশগুলোতে এই অবস্থা বেশি দেখা যাচ্ছে। এ বছর ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির দাম প্রায় ১০ শতাংশ, মিশরীয় পাউন্ড ২০ শতাংশ এবং তুর্কি লিরা ২৮ শতাংশ কমেছে।

ইস্তাম্বুলে শিশুদের পোশাক এবং ডায়াপার ব্যাগ বিক্রি করেন সেলাল কালিলি (৬০)। ডলার দিয়ে বাইরে থেকে আমদানি করা জিপার এবং লাইনার কিনতে তাকে এখন বাড়তি লিরা খরচ করতে হয়। ফলে তাকে তুর্কি গ্রাহকদের জন্য দাম বাড়াতে হচ্ছে। কিন্তু সাধারণ ক্রেতাদের হাতেও অর্থ নেই। তাই তারাও কালিলির পোশাক কিনতে পারছে না। 
তবে ধনী দেশগুলিও সংকটের বাইরে নয়। ইউরোপে এরইমধ্যেই বিদ্যুতের দামের ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। পুরো মহাদেশটিই এখন মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গত ২০ বছরে প্রথমবারের মতো এক ইউরোর মূল্য এখন এক ডলারের থেকে কম। বৃটিশ পাউন্ডের দামও এক বছর আগের তুলনায় ১৮ শতাংশ কমেছে। প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের মিনি-বাজেট ঘোষণার পর পাউন্ডের দাম কমে প্রায় ডলারের সমান হয়ে গেছে। এ জন্য যদিও তিনি এরইমধ্যে তার অর্থমন্ত্রী কোয়াসি কোয়ার্টেংকে বরখাস্ত করেছেন। 
সাধারণত, দেশগুলি মুদ্রার পতন থেকে কিছু সুবিধা পেতে পারে। কারণ এটি তাদের পণ্যগুলিকে বিদেশে সস্তা এবং আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলে। কিন্তু এই মুহুর্তে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রায় সর্বত্রই থমকে আছে। শক্তিশালী ডলার বিভিন্ন উপায়ে বিশ্বজুড়ে সংকট তৈরি করছে। প্রথমত, ডলারের দাম বাড়লে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে ওঠে। 

দ্বিতীয়ত, ঋণ পরিশোধে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়। কারণ ঋণ পরিশোধ করার সময় ডলারে রূপান্তর করতে আগের তুলনায় বেশি স্থানীয় মুদ্রার প্রয়োজন হয়। তৃতীয়ত, বিশ্বের দেশগুলো নিজেদের মুদ্রার মান ঠিক রাখতে সুদের হার বৃদ্ধি করে। কিন্তু এভাবে উচ্চ সুদের হার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে দুর্বল করে এবং বেকারত্ব বাড়ায়। ক্যাপিটাল ইকোনমিক্সের আরিয়ান কার্টিস বলেন, সহজ করে বললে ডলারের দাম বৃদ্ধি বিশ্ব অর্থনীতির জন্য খারাপ খবর। আগামী বছর বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মধ্যে পড়বে বলে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে ডলারের দাম বৃদ্ধি তার অন্যতম প্রধান কারণ। 

এর আগেও ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে বহুবার। ১৯৯০-এর দশকে এশিয়ান আর্থিক সঙ্কটের সময়ও এমন অবস্থা দেখা যায়। সেসময় ইন্দোনেশিয়ান কোম্পানিগুলি প্রচুর পরিমাণ ডলারে ঋণ নিয়েছিল। কিন্তু ইন্দোনেশিয়ান মুদ্রা রুপিয়ার দাম ডলারের বিপরীতে অনেক পড়ে গেলে, এসব কোম্পানি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কয়েক বছর আগে মেক্সিকোর মুদ্রা পেসোর দাম কমে যাওয়ায় দেশটিতে একই রকম সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। 
যদিও ২০২২ সালে ডলারের দামের ঊর্ধ্বগতি অন্য বারের থেকে আলাদা। কারণ, এখন এমনিতেই বিশ্বের অর্থনীতি খারাপ সময় পার করছে। ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে জ্বালানি ও খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকা- ব্যহত হয়েছে। সেসময়ও বিশ্বের অনেক দেশ মন্দার মধ্য দিয়ে গেছে। কিন্তু মহামারি চলে গেলেও অর্থনীতি আগের পর্যায়ে আনার সুযোগ পায়নি দেশগুলো। 

২৯ বছরের রেমন্ড মানাওগ ম্যানিলায় মিনি-বাস চালান। তিনি অভিযোগ করেন, মুদ্রাস্ফীতির কারণে তাকে এখন অতিরিক্ত কাজ করতে হচ্ছে। তার ভাষায়, দৈনন্দিন খরচের জন্য যথেষ্ট উপার্জন করার জন্য আমাদের সব কিছু করতে হয়। আগে আমরা যেখানে পাঁচবার ট্রিপ দিয়েছি, এখন সেখানে ছয়বার দেই। 

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে কাজুবাদাম আমদানি করেন রবীন্দ্র মেহতা। গত কয়েক দশক ধরেই তিনি উন্নতি করছিলেন। কিন্তু এখন রুপির রেকর্ড পতন এবং এরসঙ্গে কাঁচামাল ও শিপিং খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় তার আয় থেমে গেছে। কারণ, এখন তাকে এখন কাজুবাদাম আমদানিতে বেশি ব্যয় করতে হয় এবং ভারতীয় বাজারেও তা বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। এতে মানুষজনও বাদাম কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। মেহতা জানান, আগস্ট মাসে ভারত ৪০০ কন্টেইনার বাদাম আমদানি করে। গত বছর একই সময়ে এই আমদানি ছিল ১২৫০ কন্টেইনার। যদি ভোক্তারা না কেনে তাহলে তবে এটা মেহতাসহ গোটা সাপ্লাই চেইনকেই প্রভাবিত করে। 

বৃটেনের অন্যতম বড় ওয়াইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংসল্যান্ড ড্রিংকস। এমনিতেই কোম্পানিটি শিপিং, বোতল, ক্যাপ এবং জ্বালানির খরচ বৃদ্ধিতে হিমশিম খাচ্ছিল। এরমধ্যে এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে ডলারের দাম বৃদ্ধি। এতে করে তাদের এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি দাম দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, চিলি এবং আর্জেন্টিনা থেকে কাচামাল কিনতে হচ্ছে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই এখনও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য ডলারের উপর নির্ভর করে। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এড বেকার এখন বলছেন, শিগগিরই গ্রাহকদের তাদের ওয়াইনের জন্য আরও বেশি খরচ করা শুরু করতে হবে।

সূত্র-মানবজমিন ডেস্ক