ঢাকায় ক্রমেই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। হাসপাতালগুলোতে জায়গা নেই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দার মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেক ডেঙ্গু রোগী। চিকিৎসক বলেন, ‘সিট নাই, কী করব? এভাবেই চিকিৎসা দিচ্ছি।’এ হাসপাতালে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এসেছে ভর্তির জন্য। লাইনে দাঁড়ানো রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশির ভাগই জ্বর নিয়ে এসেছেন।

মেয়ের জ্বর নিয়ে ডেমরা থেকে এসেছেন কল্পনা খাতুন। পাঁচ বছরের মেয়ে বীথির ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। বাসার আর কারও হয়েছে কি না আর মশারি ব্যবহার করেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আর কারও হয় নাই। বাচ্চা ঘুমালেই মশারি দিই। ডেঙ্গু বাড়তেছে জানি, তাই বাসায় কোনো পানিও জমতে দিই না। বাচ্চাকাচ্চা তো বাইরে খেলতে যায়। কীভাবে মশা কামড়ালো বলতে পারি না।’

শাহিদা বেগম এসেছেন গাজীপুর থেকে তার স্বামী মকবুল হোসেনকে নিয়ে। স্বামীর দুই দিন থেকে জ্বর কমছে না বলে জানান তিনি। ধারণা করছেন ডেঙ্গু।

কত দিন থেকে জ্বর জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তিন দিন হইয়া গেছে। ভাবলাম এমনি জ্বর হইলে ঠিক হইয়া যাইব, কিন্তু কমতেছে না। তাই হাসপাতালে নিয়া আসছি।’

ওই সময় দায়িত্বরত একজন চিকিৎসক বলেন, ‘রোগী প্রতিদিনই বাড়ছে। অনেকে বুঝতে পারে না ডেঙ্গু নাকি সাধারণ জ্বর। কারণ সব সময় লক্ষণ মেলে না। তাই দেরিতে আসে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ইকরামুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা হটস্পটের (ডেঙ্গুপ্রবণ এলাকা) ভিত্তিতে অভিযান চালাচ্ছি।’

‘হটস্পট’ কীভাবে চিহ্নিত করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের সংখ্যা দেখে ঠিকানা সংগ্রহ করা হয়। যেসব এলাকা থেকে বেশি রোগী আসে, সেটাকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখন পর্যন্ত মুগদা, মিরপুর, উত্তরা, খিলক্ষেত, যাত্রাবাড়ীসহ কিছু এলাকাকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।’

মশা নিধনে এত অভিযানের পরও কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এবার রাজধানীতে নির্মীয়মাণ ভবনগুলোতে অতিরিক্ত এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এই সোর্সগুলো মানুষের সৃষ্টি। পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যায়, প্রতি একজন মানুষের বিপরীতে দেড় লাখ মশা। আর রাজধানীতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৫ হাজার লোক বাস করে, যেখানে উন্নত বিশ্বে ৩০০ থেকে ৫০০ জনের বাস। সে ক্ষেত্রে জনসংখ্যার ঘনত্বের জন্য ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

‘এ বছর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অক্টোবর মাসে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে, যেটা এর আগের বছরগুলোতে দেখা যায়নি। তাই যেখানে-সেখানে পানি জমাতে এডিস মশার লার্ভা জন্মানো কমছে না। তাই নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়ে পড়ছে।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু মোকাবিলায় কাজ করছে। এগুলো তো এক দিনে হয় না। এ বছর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অক্টোবর মাসে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে।

‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মশা নিয়ন্ত্রণ করে না। তারা যে হটস্পট আইডেন্টিফাই করেছে, এর মধ্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ (যেমন: মুগদা, মিরপুর, কেরানীগঞ্জ, উত্তরা, খিলক্ষেত, যাত্রাবাড়ী, বাসাবো) বিভিন্ন জায়গা চিহ্নিত করে দিয়েছে তারা। এরপর সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব সেই এলাকার মশা নিধন করা।

‘আমরা বলেছি, ফগিংয়ের মাধ্যমে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে ফেলতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাইরের লার্ভা মেরে দিতে পারলেও বাসার যেসব জায়গায় মশা জন্ম নিতে পারে, সেগুলোর ব্যাপারে সতর্কতা বাড়াতে হবে। এডিস মশার দুটি প্রজাতি আছে। এর মধ্যে ইজিপটি প্রজাতির এডিসের কামড়ে ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা থাকে ৯৫ শতাংশ। আরেকটি প্রজাতি এলবোপিকটাস, যার কামড়ে ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা ২ শতাংশ। আমরা কিন্তু জানি না কোনটি কোন প্রজাতির। আবার যদি বুঝতেও পারি এটি এডিস, কিন্তু কোন প্রজাতির সেটি বোঝার উপায় নেই। তাই ঘরে মশারি ব্যবহার করতে হবে। কাজেই মশা আপনার ঘরে কম থাকলেও আশ্বস্ত হবেন না। বাইরে গেলেও মশা নিরোধক ক্রিম ব্যবহার করতে হবে।’

ডেঙ্গু মহামারির দিকে যাচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমরা বলতে পারি এটি সেদিকেই যাচ্ছে। অক্টোবর মাসে হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে। এপিডেমিক মানেই মহামারি। সেই হিসেবে বলা যেতেই পারে। যেসব ঝুঁকিতে রয়েছে, সেখানে সঠিকভাবে ব্যবস্থা না নিলে এটি আরও বাড়বে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে কোন কীটনাশকে এডিস মশা নিধন হয়, সেটি নিশ্চিত করাও জরুরি। সিটি করপোরেশনকে দোষারোপ করলেও ঢাকার বাইরে তো এই হটস্পট ম্যানেজমেন্টের উদ্যোগে কেউ নেই। এভাবে প্রতিটি জায়গায় সচেতনতা না বাড়ালে এটি আরও বড় আকার ধারণ করবে।’

কথা হয় ঢাকা শিশু হাসপাতালের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি কিছুটা এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘সিট থাকলে আমরা সবাইকেই দিই। ডেঙ্গুর জন্য আলাদা কিছু না। রোগীর চাপ বেশি থাকলে সিট থাকে না। সেটা যেকোনো সময় হতে পারে।’

মুগদা ইসলামী হাসপাতাল থেকে বলা হয়, সেখানে এখনও কিছু শয্যা আছে, তবে রোগীর চাপ বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে জানানা হয়, ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে শিশু মারা গেছে ১২ জন। এখন পর্যন্ত দেশে মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ৩১ শতাংশ।

এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ২৬ হাজার ৯৩৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৯ হাজার ৪৯৮ জন এবং ঢাকার বাইরে সারা দেশে ভর্তি রোগী ৭ হাজার ৪৪০ জন।

একই সময়ে সারা দেশে ছাড়প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ২৩ হাজার ৬১২ জন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে ১৭ হাজার ২৯৫ জন এবং ঢাকার বাইরে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে ৬ হাজার ৩১৭ জন।

১ অক্টোবর থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে ১০ হাজার ৮৪৬ জন। সেপ্টেম্বরে এ সংখ্যা ছিল ৯ হাজার ৯১১ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারিতে এ সংখ্যা ছিল ১২৬ জন। অর্থাৎ ১০ মাসে রোগী বেড়েছে প্রায় ১০ গুণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) আহমেদুল কবির বলেন, ‘আমরা দেশের বড় বড় সরকারি হাসপাতালে কথা বলেছি। তারা বলছে ডেঙ্গু নিয়ে এখনও কোনো চ্যালেঞ্জ নেই।

‘জ্বর বেশি থাকলে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে না। জ্বর কমার পর ব্লাড প্রেশার কমে যায়। প্লাটিলেটও কমে যায়, কিন্তু ডেঙ্গু হলেই যে ব্লাড বা প্লাটিলেট দিতে হবে, এমন না। প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে এলে তখন এগুলো দেয়ার প্রয়োজন পড়ে।

‘এ ক্ষেত্রে সব সময় বলা হয় সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি। বাড়ির আশপাশে পানি জমতে না দেয়া, কনস্ট্রাকশনের কাজ চললে সেই জায়গাগুলোতে যেন পানি জমতে না পারে। বাসার ফ্রিজের নিচে যে ট্রেতে পানি জমে, এটা অনেকেই খেয়াল করেন না। এটি পরিষ্কার রাখতে হবে। সবার সচেতনতা থাকলে ডেঙ্গু নিরসন করা সম্ভব।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস গত বুধবার বলেন, ‘ডেঙ্গু নিধনে আমাদের যেসব কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে, তার কারণে আমি মনে করি, আমরা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছি।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান বলেন, ‘আমরা ডেঙ্গু নিরসনে চিহ্নিত হটস্পটগুলো নিয়ে কাজ করছি। মুগদা, মিরপুর, কেরানীগঞ্জ, উত্তরা, খিলক্ষেত, যাত্রাবাড়ী, বাসাবোর বেশির ভাগ জায়গাই ঝুঁকিপূর্ণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হটস্পট চিহ্নিত করার পর আমরা কাজ করছি- এমন না। আমরা নিজেরাও প্রতিদিন হটস্পট চিহ্নিত করছি। আমাদের যেসব কর্মী এবং ডাক্তার আছেন, তাদের দক্ষতা অ্যানথ্রোপলজিস্টের চেয়ে কম নয়।’

তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড- এসব দেশের পরিস্থিতি আরও খারাপ। আমাদের পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনা করতে হবে। সিঙ্গাপুরের জনসংখ্যার তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যার সঙ্গে বাংলাদেশেরটা তুলনা করলেই বোঝা যাবে।

‘সবচেয়ে বড় কথা, সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রতিটি জেলায় প্রতিটি বাড়িতে নিজেদের জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে।’

সূত্র-এমি জান্নাত

আরও পড়ুন

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো আছে কি না বুঝবেন যেভাবে

যেসব বিষয়ের উপর নির্ভর করে শিশুর উচ্চতা

ঘরে বসে শিশু কী করবে? রইলো ১১টি আইডিয়া