বাংলাদেশে বেসরকারি কর্মক্ষেত্রের বিরাট অংশ বিদেশিদের দখলে। এটি বেশ পুরোনো খবর। চীন, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা নাগরিকরা বেসরকারি খাতের বহু উচ্চ পদে চাকরি করছেন। এর মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যাই সর্বাধিক। কদিন আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্বোধনের এক বক্তব্যে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেছেন, 'আমাদের শিক্ষার্থীদের সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে। তাদের বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। দেশের কর্মক্ষেত্রের বিশাল অংশ বিদেশি নাগরিকরা দখল করে আছে। আমাদের শিক্ষার্থীদের দক্ষ করে বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে।' আমরা শুধু বছরের পর বছর এমন বক্তব্য-বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ থাকছি। বাস্তবে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা কি নিতে পারছি? পারছি না। আর তাই দিনকে দিন বেসরকারি খাতের উচ্চ পদে বিদেশিদের অংশগ্রহণ বাড়ছে।

বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করে যা জানা যায়, তা হলো- এক ভারতীয়দেরই বৈধ-অবৈধ উপায়ে এ দেশের বেসরকারি চাকরির বাজারে উচ্চ পদে কর্মসংস্থানের যে অবস্থা তাতে চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার মতো অবস্থা। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয়রা চাকরি করে যে রেমিট্যান্স পাঠায় তা ভারতের চতুর্থ রেমিট্যান্সের উৎস। বিদেশি প্রায় সবাই এ দেশে উচ্চ পদে চাকরি করতে আসে। তাদের বেতন ১-২ লাখ থেকে শুরু করে ১০-১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ক'বছর আগের এক চিত্রে দেখা যায়- সরকারি কর্মসংস্থান মাত্র ৩.৮%। অবশিষ্ট পুরোটাই মেটায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। আর এই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে আসীন বিদেশিরা। বিশেষ করে ভারতীয়রা। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সালে ৫ লাখ ভারতীয় নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। তারা অনেকে ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন এনজিও, গার্মেন্ট ব্যবসা, টেপটাইল ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কাজে নিযুক্ত হয় এবং হুন্ডির মাধ্যমে নিজ দেশ ভারতে রেমিট্যান্স প্রেরণ করে। এই ৫ লাখের বাইরে বিপুল সংখ্যক বৈধ ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে কাজ করা জনবলও রয়েছে। গত ১৩-১৪ বছরে সংখ্যাটি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে- একবার ভাবুন? বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে এখন ১০-১২ বিলিয়ন ডলার আয় করার ফলে ভারতীয়দের জন্য যা তাদের চতুর্থ বৃহৎ রেমিট্যান্স আয়ের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে অবৈধ পথে পাঠানো অর্থের হিসাবের চেয়ে আরও বেশি বলে ধারণা করছে সংশ্নিষ্ট মহল। একবার ভাবুন তো, ১০ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ কোটি টাকা যদি বিদেশে না গিয়ে আমাদের দেশে থেকে যেত তাহলে এই একটি খাত থেকেই দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াত? 

বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে আমাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আমরা কেন নিজেদের টপার বা সিইও তৈরি করতে পারছি না? টপ লেভেলে যাঁরা আছেন, তা খুবই স্বল্প সংখ্যক। আমরা কি দিনের পর দিন মধ্যপ্রাচ্যে স্বল্প বেতনের শ্রমিক রপ্তানি করব আর পাশের দেশ থেকে উচ্চ বেতনের সিইও আমদানি করব? কিন্তু কেন এমনটা ঘটছে? এর পেছনে প্রধান কারণই হচ্ছে আমাদের মনমানসিকতা। একজন শিক্ষার্থীর গড়ে ওঠা যদি বিশ্নেষণ করেন দেখবেন প্রতিটি নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকদের গৎবাঁধা স্বপ্ন। তাঁরা তাঁদের সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নয়তো বিসিএস অফিসার বানাবেন। আর উচ্চবিত্তরা ভাবেন, এই দেশ তাঁদের জন্য নয়। তাই সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে দেবেন। এসবের বাইরে যে বিস্তৃত পৃথিবীর বিস্তৃত কর্মক্ষেত্র আছে, সেটি উল্টেপাল্টেও দেখেন না অভিভাবক শ্রেণি। আমি হলফ করে বলতে পারি, একজন অভিভাবককেও খুঁজে পাবেন না, যিনি কিনা ভাবছেন তাঁর সন্তান একদিন এ দেশের কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সিইও হবে। আপনি যদি স্বপ্নই না দেখেন তবে সেই জায়গাটি স্পর্শ করবেন কী করে? আপনার জায়গা তো বিদেশিরা দখল করবে, সেটাই স্বাভাবিক। ছোটবেলা থেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নয়তো বিসিএস অফিসার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর শিক্ষার্থীরা যখন সেগুলো হতে পারে না, তখন ঘটনাক্রমে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একপ্রকার স্বপ্নভঙ্গের মনোবেদনা নিয়ে প্রাইভেট চাকরিতে যোগদান করে। এই স্বপ্নভঙ্গটা হতো না, যদি আগে থেকেই যার যেমন মেধা সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া হতো। যেমন- একটি ছেলে বা মেয়ের সায়েন্স পড়ার মতো মেধা নেই, তবু তাকে জোর করে সায়েন্স পড়তে চাপিয়ে দেওয়া হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-মাস্টার্স পড়ার সময় শিক্ষার্থীদের অনেক এপট্রা কারিকুলার এবং কো-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি করা উচিত। যেমন- আইডিয়া কম্পিটিশন, প্রোগ্রামিং, প্রজেক্ট, মার্কেটিং ইত্যাদি। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা শুধু রেজাল্ট-কেন্দ্র্রিক পড়াশোনা করে থাকে। যার ফলে তাদের পড়াশোনাতে অনেক ঘাটতি থাকে। কিন্তু অন্য দেশের শিক্ষার্থীরা অনার্স বা মাস্টার্সের সময় অনেক অ্যাক্টিভিটি, ক্লাব কম্পিটিশনের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যে কারণে দেখা যায় যে, তাদের শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা পরিপূর্ণ কর্মী হিসেবে গড়ে ওঠে এবং কোনো দায়িত্ব দিলে, সঠিকভাবে পালন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আমাদের কর্মীরা একপ্রকার ধুঁকে ধুঁকে পেশাজীবন বহন করে বেড়ায়। আমাদের দেশের বেসরকারি কোম্পানিগুলো এই ধুঁকে ধুঁকে পেশাজীবন পার করা অপেক্ষাকৃত কম দক্ষ কর্মীর চেয়ে বিদেশ থেকে সরাসরি দক্ষ কর্মী হায়ার করে সিইও বানায়। এখানেই আমরা পিছিয়ে পড়ি। আমাদের দেশীয় কর্মীরা যোগাযোগ বা কানেক্টিভিটিতেও যথেষ্ট দুর্বল। এ কারণে বিদেশিরা যখন এসব জব বাগিয়ে নিচ্ছে, আমরা তখন শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।

আমাদের সিইও বানাতে হলে নিজেদের দক্ষ করে তোলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। যার যেমন মেধা তার সেভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া উচিত খুব ছোটবেলা থেকেই। বিশেষ করে এসএসসির পর থেকেই মেধা অনুযায়ী কে কোন মাধ্যমে ক্যারিয়ার গড়বে, অভিভাবকদের সেই অনুযায়ী পথ দেখানো উচিত। ফলে শিক্ষার্থীদের মাইন্ড সেটআপ সেভাবে তৈরি হবে। তাহলেই যদি বেসরকারি খাতের উচ্চ পদে বিদেশিদের প্রভাব কমে। এতে করে একই সঙ্গে আমরা যেমন নিজেদের সিইও পাব, তেমনি শুধু শ্রমিক নয়; আমরা বিদেশে উচ্চ বেতনে দক্ষ সিইও রপ্তানি করতে পারব।

       সাজ্জাদ কাদির

        তথ্যচিত্র নির্মাতা

      আরও পড়ুন

 একজনের বিপরীতে দেড় লাখ মশা

শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো আছে কি না বুঝবেন যেভাবে

যেসব বিষয়ের উপর নির্ভর করে শিশুর উচ্চতা