শিক্ষাদান, গবেষণা, গবেষণা-উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং শিল্পের সঙ্গে জ্ঞানের বিনিময় সূচকে পিছিয়ে থাকার কারণে বৈশ্বিক র‌্যাংকিংয়ে সেরাদের কাতারে নেই দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। সাধারণত গবেষণার বাইরেও পাঁচটি সূচকের মানদণ্ডে তৈরি হয় সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আমাদের সরকারি-বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখনো মুখস্থনির্ভর পড়ালেখার কারণে বিশ্ব র‌্যাংকিং তো দূরের কথা দেশের সেরাও বলা যায় না।

অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার। এ লক্ষ্য পূরণে সরকার ২০ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। তবে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকায় ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বৈশ্বিক বা এশিয়ার মাপকাঠিতে সেরা উচ্চ শিক্ষাঙ্গনগুলোর তালিকায় থাকবে কিনা তা বলতে পারছেন না কেউ।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোজাম্মেল হক চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, ‘সময় এসেছে ঘুরে দাঁড়ানোর। আর কত বছর আমাদের শুনতে হবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংয়ে সেরা পঞ্চাশ তো দূরের কথা একশটির মধ্যেও নেই। র‌্যাংকিংয়ে আসতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম, চাকরির বাজারে সুনাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতি, আন্তর্জাতিক শিক্ষক অনুপাত ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী অনুপাত- মোটাদাগে এ সূচকগুলোই দেখা হয়। গড়পড়তায় লেখাপড়া চেয়ে এসব দিকগুলোয় আমাদের বেশি নজর দেওয়া উচিত।’

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী টাইমস হায়ার এডুকেশন (টিএইচই) গত বুধবার তাদের সর্বশেষ ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং প্রকাশ করেছে। এতে ১০৪টি দেশের ১৭৯৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মূল্যায়নের ভিত্তিতে এ র‌্যাংকিং করা হয়। এবারও সেরা পাঁচশর মধ্যে নেই বাংলাদেশি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। এ তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অবস্থান ৬০১-৮০০-এর মধ্যে। ৬০১-৮০০-এই ক্রমিকে আছে বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১২০১-১৫০০-এর মধ্যে। তালিকায় ১২০১-১৫০০-এর মধ্যে অবস্থান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। তবে তালিকায় প্রথমবারের মতো নাম এসছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের, এর অবস্থান ১২০০-১৫০০-এর মধ্যে। গবেষণার সূচক হচ্ছে- শিক্ষাদান (টিচিং), গবেষণা (রিসার্চ), গবেষণা-উদ্ধৃতি (সাইটেশন), আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি (ইন্টারন্যাশনাল আউটলুক) এবং ইন্ডাস্ট্রি ইনকামের (শিল্পের সঙ্গে জ্ঞানের বিনিময়) মান যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে প্রতি বছর এ তালিকা প্রকাশ করে টাইমস হায়ার এডুকেশন।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দের অভাব, জাতীয় বাজেটের স্বল্পতা রয়েছে। শিক্ষক নিয়োগেও স্বজনপ্রীতি হয়। প্রাতিষ্ঠানিক এবং দায়িত্বশীলদের দুর্নীতি রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের রয়েছে সততা, মূল্যবোধের অভাব। নেই প্রাতিষ্ঠানিক সুনাম। পাঠকক্ষে শিক্ষকের-শিক্ষার্থী অনুপাত বেশি। দক্ষতার ঘাটতিতে চাকরির বাজারে সুনাম ক্ষুণ্ণ। ক্যাম্পাসে লেখাপড়ার পরিবেশ বিঘ্নের জন্য রাজনীতির প্রভাবও কম নয়। কোথাও আবার শিক্ষার চেয়ে রাজনীতি চর্চায় বেশ মনোযোগী শিক্ষক শিক্ষার্থীরা। এসব গড়পড়তায়, উচ্চশিক্ষার দৈন্যদশার মূল কারণ।’

জানা গেছে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান র‌্যাংকিংয়ের জন্য ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিংয়ে টাইমস হ্যায়ার এডুকেশন একটি ফর্মুলা ব্যবহার করে, এরা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পৃথক পৃথক সূচকে নম্বর দেয়। যেমন- শিক্ষায় ৩০ শতাংশ, গবেষণায় ৩০ শতাংশ, গবেষণার ফল সাইটেশন ৩০ শতাংশ, আন্তর্জাতিক উপস্থিতিতে ৭.৫ শতাংশ এবং গবেষণাকর্মের বাণিজ্যিকীকরণ ২.৫ শতাংশ। এসব সূচকের বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় না থাকার জন্য মূলত তথ্যগত ঘাটতি বেশি বলে মনে করা হয়।

ইউজিসির তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালে ১০৭টি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়ের মধ্যে ৭৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে গবেষণায় ব্যয় করে ১৪৫.১০ লাখ টাকা। এ সময়ে ৪৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয় হয়েছে ৬৮৫৫.৯৪ লাখ টাকা।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষা গবেষক অধ্যাপক তাহমিনা খানম বলেন, আমাদের দেশে যে পরিমাণ গবেষণা খাতে ব্যয় এর সঠিক তথ্য উপাত্ত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটেও পাওয়া যায় না। আমাদের এখানে গবেষণার বদলে চলে মুখস্থনির্ভর ও চাকরিকেন্দ্রিক পড়ালেখা। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে দেশের মুক্ত জ্ঞানচর্চার স্থান। শিক্ষার্থীরা গবেষণা করবেন, নতুন নতুন উদ্ভাবন করবেন। কিন্তু হচ্ছে ঠিক ব্যতিক্রম। শিক্ষার্থীদের হাতে দেওয়া হচ্ছে কিছু পাঠ্যবই, লেকচার শিট, মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা আর নামমাত্র রিসার্চ পেপার, যার যথার্থতা শিক্ষকরা ঠিকভাবে বিচার করেও দেখেন না। তাদের মুক্ত জ্ঞানচর্চার সুযোগ না দিয়ে বরং ক্লাসে বাধ্যতামূলক উপস্থিতি, এসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশনের গ-িতে আবদ্ধ রাখা হয়। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তালিকায় শীর্ষে উঠে আসে এগুলো মূলত গবেষণানির্ভর বিশ^বিদ্যালয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড, হার্ভার্ড, যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এগুলোর বাজেটের বেশির ভাগই গবেষণায় ব্যয় করা হয়।

সূত্র-আমাদের সময়