ব্রুনাইয়ের সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ তিনদিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে আসছেন ১৫ই অক্টোবর। এই মূহুর্তে বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে সিংহাসনে থাকা শাসকদের অন্যতম তিনি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রথমবারের বাংলাদেশ সফরে আসছেন সুলতান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ২০২০ সালে তার এই সফরটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিডের কারণে সেটি পিছিয়ে এখন হচ্ছে। ১৯৬৭ সালে তার বাবা স্যার হাজি ওমর আলী সাইফুদ্দিন সিংহাসন ত্যাগ করার পর ১৯৬৮ সালের অগাস্টে হাসানাল বলকিয়াহ ব্রুনাইয়ের সুলতান হিসেবে রাজমুকুট পরিধান করেন।

তিনি একই সঙ্গে ব্রুনাইয়ের প্রধানমন্ত্রী এবং দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা। এছাড়া তিনি বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের একজন এবং শাসক হিসেবেও শীর্ষ সম্পদশালীদের অন্যতম। বিলাসবহুল জীবন এবং ইসলামী শরিয়া আইনে দেশ চালানোসহ নানা কারণে আলোচিত এই সুলতানের জীবন।

রক্ষণশীল শাসক

বিশ্বজুড়ে সর্বশেষ টিকে থাকা পূর্ণাঙ্গ রাজতন্ত্রগুলোর একটি এটি। ১৯৬৮ সালে সুলতান হন হাসানাল বলকিয়াহ। তখন থেকে তার হাতেই সব নির্বাহী ক্ষমতা। তিনি একাধারে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং অর্থমন্ত্রী।

রাজতান্ত্রিক ইসলামিক শাসনে পরিচালিত দেশ ব্রুনাই একসময় ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল, ১৮৮৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে আসে দেশটি।

একমাত্র মালয় রাজ্য হিসেবে ১৯৬৩ সালে ব্রুনাই ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, এর মাধ্যমে দেশটি মালয়েশিয়ার অংশ হবার জন্য গঠন করা ফেডারেশনে যোগদানের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছিল।

এরপর ১৯৭৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ব্রিটেনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ। এরপর ১৯৮৪ সালে পূর্ণ স্বাধীনতা পায় ব্রুনাই। কিন্তু ওই বছরই সুলতান দেশটির পার্লামেন্ট সাসপেন্ড করেন। ২০ বছর পর ২০০৪ সালে সুলতান পার্লামেন্ট নতুন করে চালু করেন।

পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, এর মাধ্যমে দেশটির জনগণকে কিছু রাজনৈতিক অধিকার দেয়া হয়। ২০১৪ সালে পূর্ব এশিয়ার প্রথম দেশ হিসেবে ব্রুনাই ইসলামিক শরিয়া আইনে দেশ চালানোর ঘোষণা দেয়। দেশটির আইনে পরকীয়া প্রেমের শাস্তি পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড এবং চুরির সাজা হিসেবে হাত কেটে নেওয়ার বিধান আছে।

১৯৯১ সালে তিনি দেশটিতে 'মালয় মুসলিম মোনার্কি' নামে নতুন এক রক্ষণশীল ভাবধারা চালু করেন, যার মাধ্যমে সম্রাটকে ধর্মের রক্ষাকারী বা রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।

পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, মূলত ব্রুনাইতে গণতন্ত্রের দাবি ওঠা ঠেকানোর জন্য এটি করা হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে ওই নীতির ফলে দেশটির বিপুল সংখ্যক চীনা এবং বিদেশী নাগরিকেরা মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এছাড়া ২০১৯ সালে দেশটিতে সমকামিতার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রেখে একটি আইন করা হয়।

আইনে পুরুষে পুরুষে যৌনকর্ম এবং পরকীয়া সম্পর্কের জন্য পাথর ছুড়ে মৃত্যুর বিধান রাখা হয়েছে। ওই আইন পাস হওয়ার পর পশ্চিমা দুনিয়ায় ব্রুনেইয়ের সুলতানের ব্যাপক সমালোচনা হয়, যাতে সামিল হয়েছিলেন স্যার এলটন জন এবং জর্জ ক্লুনির মত বিখ্যাত তারকারাও।

সেসময় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুলতানকে দেওয়া সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রত্যাহারের ডাক দিয়েছিলেন মানবাধিকার কর্মীরা। আন্দোলনের মুখে সুলতান নিজেই তার ডিগ্রি ফিরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন।

যদিও সুলতান পরে ওই আইন থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রহিত করেন। কিন্তু ব্রুনাইয়ে আগে থেকেই সমকামিতা নিষিদ্ধ ছিল এবং এজন্য ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান ছিল।

ব্রুনাইতে কোনো বিরোধী দল নেই, এমনকি স্বাধীনতার পর থেকে কোনো স্বাধীন সিভিল সোসাইটি গ্রুপও গড়ে উঠেনি। সরকারের বিরোধিতা গণ্য হতে পারে রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবেও, যার শাস্তি অত্যন্ত কঠিন।

জনপ্রিয় শাসক

দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ ব্রুনাই ভৌগলিকভাবে দক্ষিণ চীন সাগরের কোলে অবস্থিত, বোর্নিও দ্বীপের উপকূলে দেশটির নিকটতম প্রতিবেশীদের মধ্যে আছে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং কম্বোডিয়া। ১৯৪৬ সালে জন্মগ্রহণ করা হাসানাল বলকিয়াহ মালয়েশিয়া এবং ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেছেন।

তিনি ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন পাইলট। দীর্ঘদিন ধরে দেশ শাসন করলেও প্রজাদের কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয়। তেল ও গ্যাসের বিপুল মজুদের কল্যাণে ছোট্ট একটি দেশ ব্রুনাইয়ের জনগণের জীবনযাত্রার মান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয়।

এ দেশের মানুষকে কোন আয়কর দিতে হয় না সরকারকে। বরং বিভিন্ন সরকারি স্কিম বা কর্মসূচীর অধীনে সুলতান নিয়মিত জনগণের মধ্যে জমি এবং বাড়িঘর বিতরণ করে থাকেন। এসব কারণে ব্রুনাইয়ের জনগণের কাছে সুলতান বেশ জনপ্রিয়।

বিলাসবহুল জীবন

সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ তার বিলাসবহুল জীবনযাত্রার জন্যও বেশ আলোচিত। এক সময় তিনি ছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী এবং এখন তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় তিন হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ৬০০ বছরের বেশি পুরনো রাজবংশের উত্তরাধিকারী সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ উত্তরাধিকার সূত্রেই বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।

এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনেকগুলো বিলাসবহুল হোটেলের মালিক সুলতান। এছাড়াও এসব দেশে বিপুল ভূ-সম্পত্তিরও মালিকানা রয়েছে তার।

সুলতানের দুইজন স্ত্রী এবং ১১ জন সন্তান। বিশাল প্রাসাদ, বিভিন্ন দেশে পাঁচ-তারা হোটেল, সোনায় মোড়ানো রোলস্‌রয়েস, হাজারো গাড়ির বহর, সোনার প্রলেপ দেয়া বোয়িং, মহামূল্য চিত্রকর্মের বিশাল সংগ্রহ, পোলো খেলা- হাসানাল বলকিয়াহর পরিচয়ের সাথে এসব বিষয় যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

ব্রুনাইয়ের দারুসসালামে অবস্থিত সুলতানের প্রাসাদ ইস্তানা নুরুল ইমান আকারে ভ্যাটিকান বা বাকিংহাম প্রাসাদের চাইতে অনেকগুণ বড়। গিনেস বুক অব রেকর্ডস অনুযায়ী এটি বিশ্বের সবচাইতে বড় প্রাসাদ। এই প্রাসাদে কক্ষের সংখ্যা ১৭০০।

হাসানাল বলকিয়াহর রয়েছে এক বিশাল গাড়ির বহর। বলা হয়ে থাকে তার বহরে সাত হাজারের মত গাড়ি আছে, যার মোট মূল্য ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার। তার গ্যারেজের সংখ্যা ১১০টি।

বহরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বাহন তার সোনায় মোড়ানো রাজকীয় রোলস্‌রয়েস। বিশেষ ডিজাইনের রোলস্‌রয়েসের ছাদ খোলা এবং পেছনে ছাতা সংযুক্ত করা।

এতে চেপে তিনি নিজে যেমন শহর পরিভ্রমণ করেন, তেমনি রাজপরিবারের সদস্যদের বিয়েশাদীর অনুষ্ঠানের পর প্রথা অনুযায়ী প্রজাদের দর্শন দিতেও ব্যবহার হয় এই গাড়ি। এটি ছাড়াও মোট ৬০০টির মত রোলস্‌রয়েস গাড়ির মালিক সুলতান।

ধারণা করা হত, নব্বইয়ের দশকে বিক্রি হওয়া বিশ্বের অর্ধেক রোলস্‌রয়েসের মালিক সুলতান এবং তার পরিবার। এছাড়া কয়েকশ' ফেরারি গাড়ি আছে তার। এর বাইরে ল্যাম্বরগিনি, পোর্সেসহ দুর্লভ এবং লিমিটেড এডিশন গাড়িরও লোভনীয় বহর আছে সুলতানের।

সুলতানের প্রাইভেট জেট বহরে আছে বোয়িং ৭৪৭-৪০০, বোয়িং ৭৪৭-২০০ এবং একটি এয়ারবাস বিমান। বিমান বহরের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত বোয়িংটি সোনার প্রলেপ দেয়া, যাকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে 'উড়ন্ত প্রাসাদ' বলে অভিহিত করা হয়।

সুলতান হাসানাল বলকিয়ার রয়েছে বহুমূল্য চিত্রকর্মের বিশাল সংগ্রহ। এর মধ্যে পাবলো পিকাসো এবং পিয়ের-অগস্ত্য রেনোয়াঁর একাধিক আসল চিত্রকর্মের মালিক তিনি।

তার ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতে এসেছিলেন 'কিং অব পপ' খ্যাত মাইকেল জ্যাকসন। বলা হয়ে থাকে সেই অনুষ্ঠানের জন্য মাইকেল জ্যাকসনকে সাত মিলিয়ন ডলার পারিশ্রমিক দেয়া হয়েছিল। এছাড়া সুলতান ঘোড়া পছন্দ করেন এবং পোলো খেলতে ভালোবাসেন।

তিনি ফ্যাশনেবল পোশাক পরতে পছন্দ করেন। তার ব্যক্তিগত পরিচর্যার ব্যয়ও বিপুল। দ্য টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, সুলতানের চুল কাটার জন্য তার নিজের মালিকানাধীন ব্রিটেনের দ্য ডরচেষ্টার হোটেলের একজন নাপিত নিয়মিত বিমানের প্রথম শ্রেণীতে চেপে উড়ে যান ব্রুনাই।

বিমান ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ বাদে তার পারিশ্রমিক কুড়ি হাজার মার্কিন ডলার এবং ওই নাপিতকে প্রতিবার নগদ অর্থে পারিশ্রমিক প্রদান করা হয়।