‘আমি নিজের ইচ্ছমতো চলি। আমি নিশ্চিত তুমিও তাই। আমার যদি মনে হয় তোমাকে সাহায্য করতে পারব, তাহলেই আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি’—কথাটা এমন একজনের, যিনি বিশ্বের বড় বড় অ্যাথলেটের মন নিয়ে নাড়াচাড়া করেন। ডেভিড প্রিয়েস্টলি। ২০১৮ সালে এমিলিয়ানো মার্তিনেজের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎয়ে তাঁকে কথাগুলো বলেছিলেন এই মনোবিদ।
খেলোয়াড়দের মনের চিকিৎসা করাতে ২০১৪ সালে আর্সেনাল তাঁকে ডেকেছিল। মার্তিনেজ তখন আর্সেনালে। ডেভিড ওসপিনা ও পিওতর চেকদের সঙ্গে অনুশীলনে বাজি ধরতেন। কে বেশি পেনাল্টি সেভ করতে পারে! মাঠের ভেতর চেকদের সঙ্গে সেই অনুশীলন আর মাঠের বাইরে প্রিয়েস্টলির সঙ্গে অনুশীলন করেই এই মার্তিনেজ এখন আর্জেন্টিনার ত্রাতা।


বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে কাল রাতে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনার ৪–৩ ব্যবধানের জয়ের নায়ক। ডাচদের দুটি পেনাল্টি সেভ করেছেন। পেনাল্টি শুটআউটকে বলা হয় ‘লটারি’। আবার কেউ কেউ বলেন, মনের জোর থাকলে এই লটারিও জেতা সম্ভব। মার্তিনেজের মনের জোর কতটা নিশ্চয়ই তা জানতে ইচ্ছে করছে?বিজ্ঞান এখনও মনের জোর মাপার যন্ত্র আবিষ্কার করতে না পারলেও আর্জেন্টিনাকে সেমিফাইনালে তোলার পর মার্তিনেজের একটি কথায় তা আন্দাজ করে নেওয়া যায়, ‘আরও সেভ করতে পারতাম।’


মার্তিনেজের এই যে এতটা আত্মবিশ্বাস, তার পেছনে কিন্তু প্রিয়েস্টলির অবদান কম নয়। আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম ‘লা নাসিওন’ জানিয়েছে, আর্সেনালের কিংবদন্তি কোচ ওয়েঙ্গারের পরামর্শে চার বছর আগে আর্জেন্টিনা দলের সঙ্গে কাজ করা শুরু করেন প্রিয়েস্টলি। বিশ্বকাপ সামনে রেখে আর্জেন্টিনা দলও তাঁকে সাদরে টেনেছে। ফলও পাচ্ছে হাতেনাতে।সৌদি আরবের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে হারের পর মার্তিনেজ দোষারোপ করেছেন নিজেকেই। দলকে বাঁচাতে তেমন কিছুই করতে পারেননি। গ্রুপপর্ব পেরিয়ে শেষ ষোলোয় ওঠার পর দায়টা শোধ করতে চেয়েছিলেন আর্জেন্টিনা গোলকিপার। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শেষ ষোলোয় তাই ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে সেই অবিশ্বাস্য সেভটা দেখা গেছে। আর্জেন্টাইন সমর্থকেরাও হাপ ছেড়ে বেঁচেছেন।

আরও পড়ুন

ইংল্যান্ডের বদলে যাওয়ার নেপথ্যে

এই যে দেশের মানুষের স্বপ্নকে টিকিয়ে রাখলেন যিনি, সৌদি আরবের বিপক্ষে সেই হারের পর তাঁর নাকি রাতে ঘুম হতো না, ‘ভুগেছি অনেক। ঘুমোতে পারিনি। মনোবিদের সঙ্গে এ নিয়ে অনেক কথা বলেছি। সাড়ে ৪ কোটি আর্জেন্টাইন আমার দিকে তাকিয়ে, তাদের আরও ভালো কিছু উপহার দিতে পারতাম।’কাল রাতের পর কোনো আর্জেন্টাইন বলতে পারবেন না, মার্তিনেজ তাঁর দেশকে কোনো ‘উপহার’ দেননি। কাল রাতের পর কেউ বলতে পারবে না, মার্তিনেজের মনে জোর নেই। চোখেমুখে যে আত্মবিশ্বাসের ঝলকানি নিয়ে তিনি প্রতিবার পোস্টের নিচে দাঁড়িয়েছেন, দুটি সেভের পরও চোখমুখ ফেটে বেরিয়ে আসার আবেগের ঢেউকে যেভাবে সংবরণ করেছেন শেষ বাঁশি বাজা পর্যন্ত ; যে কেউ বলবেন, এই মানুষটার মন ইস্পাতের মতোই দৃঢ়।


মার্তিনেজকে এমন ইস্পাতদৃঢ় গোলকিপার হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে প্রিয়েস্টলি যে শ্রম দিয়েছেন, তার বিশদ ব্যাখ্যা করেননি। চিকিৎসা নিচ্ছেন এমন কোনো খেলোয়াড়কে নিয়েই তিনি কখনো সেভাবে মুখ খোলেননি। তবে যুক্তরাজ্যের এক কনফারেন্সে অ্যাথলেটদের জীবন নিয়ে তাঁর কিছু কথা থেকে ধারনা মেলে, ‘বেশির ভাগ অ্যাথলেটকেই তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পরিস্থিতি পার করতে হয়। সঙ্গে থাকে মানুষের প্রত্যাশার চাপ। ঘর ও পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়। জীবন পাল্টে দেওয়া চোট ও প্রচুর টাকার হাতছানিও আছে। এসবই স্বাভাবিক বিকাশের পথে এসব সমন্বয় করতে হয়।’


গত বছর কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে টাইব্রেকারে তিন সেভ এবং ফাইনাল জয়ের আগেও মার্তিনেজের জীবনটা এভাবে নায়ক হয়ে ওঠার পথে মোড় নেয়নি। আর্সেনালের বয়সভিত্তিক দল থেকে ২০১২ সালে মূল দলে যোগ দিলেও পরের ৭ বছরে ধারে খেলেছেন ৬টি ক্লাবে। আর্সেনাল ছেড়ে অ্যাস্টন ভিলায় যোগ দেন দুই বছর আগে। তারও দুই বছর আগে থেকে প্রিয়েস্টলির সঙ্গে সেশনের পর সেশন কাটানো মনোবিদের গুরুত্বটা বোঝেন। এই যে গত দুই বছরে তাঁর জীবনটা পাল্টে গেছে, এর পেছনে প্রিয়েস্টলির অবদান কি কিছু কম? মার্তিনেজ অন্তত তা মনে করেন না।

আরও পড়ুন

শীতলতার অনঢ় মূর্তি মিরাজ

স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম ‘এল পাইস’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, ‘চার বছর আগে এক মনোবিদের সঙ্গে কাজ শুরু করি। সে আমাকে পাল্টে দিয়েছে। প্রতি ম্যাচের আগেই সে আমাকে প্রস্তুত করে। মাথা পরিষ্কার করে মাঠে নামি। আমার মনে হয়, সব খেলোয়াড়েরই মনোবিদের দরকার। এখন তো যে কেউ খেলোয়াড়দের ওপর নিজের ক্ষোভ ঢালতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আছে। এর মধ্যেই মাথা পরিষ্কার রাখতে হয়।’


৫০ বছর বয়সী ব্রিটিশ মনোবিদ প্রিয়েস্টলি আর্সেনাল ও চেলসির সাবেক গোলকিপার পিওতর চেকের সঙ্গেও কাজ করেছেন। নিজের খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার, অধিনায়ক হওয়া থেকে প্রিমিয়ার লিগের একটি ক্লাবের টেকনিক্যাল পরিচালক হওয়া—এসব কিছুর পেছনেই প্রিয়েস্টলির অবদান দেখেন চেক। আর মার্তিনেজ?


নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে কাল আর্জেন্টিনার জয়ের পর মার্তিনেজকে ভালোমতো খেয়াল করেছেন? মাটিতে থেকে লিওনেল মেসি তাঁকে তোলার পর ডাচদের ডাগ আউটের সামনে গিয়ে ভালো করে দু কথা শুনিয়েছেন। ডাচ কোচ লুই ফন গালকেও ছাড়েননি। এই ম্যাচের আগে ফন গাল যেভাবে ছাড় দেননি আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের। আর এর পাশাপাশি আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়দের সঙ্গে তাঁর অতীতের তেতো কিছু স্মৃতি তো আছেই। মার্তিনেজকে ওই মুহূর্তে দেখে মনে হয়েছে, এসবকিছু্র জবাব দিয়ে সুদে–আসলে সব তুলে নিতে চান। একটিবারের জন্যও মনে হয়নি, এই মাত্র দেশের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখা মানুষটি আবেগে ভেসে যেতে পারেন। হ্যাঁ, আবেগ বান ডেকেছিল, কিন্তু সেটা মনের ভেতর। হয়তো ড্রেসিংরুমে গিয়ে উদ্‌যাপনের জন্য তখন মনের দরজায় খিড়কি এঁটেছিলেন। কেন?


ওই যে, মনোবিদ মার্তিনেজকে শিখিয়েছেন, আবেগটা নিজের জন্য, বাকিটা প্রতিপক্ষের। মার্তিনেজের কাছ থেকে এই ‘বাকি’টাই কাল রাতে পেয়েছে নেদারল্যান্ডস। মনে মনে সেই প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলেন।এই ম্যাচের আগে বলেছিলেন, ‘আমি দেশের জার্সিতে ইতিহাস গড়তে চাই। তাই সামনের ম্যাচে সবকিছু নিংড়ে দেব। নেদারল্যান্ডস কৌশলগতভাবে খুব ভালো দল। কিন্তু আমরাও খুব ভালো।’

আরও পড়ুন

মিরাজের ‘অভয়’ হয়ে ছিলেন মুস্তাফিজ

এই যে অফুরন্ত আত্মবিশ্বাস, এই যে দম, এই যে ইস্পাতকঠিন মানসিকতায় ভেতরে পেঁজা তুলোর মতো আবেগকে একপাশে সরিয়ে রেখে লড়াই করা—সেজন্য প্রিয়েস্টলিকে এতক্ষণে নিশ্চয়ই একটা ধন্যবাদ দিয়েছেন মার্তিনেজ।

সূত্র-প্রথম আলো