বিসিএসসহ বিভিন্ন নন–ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষা ও চাকরিজীবীদের বিভাগীয় পরীক্ষায় প্রশ্ন প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকার পক্ষে মত দিয়েছে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) প্রশ্ন প্রণয়নসংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি। এখন থেকে সব প্রশ্নের ক্ষেত্রেই বিতর্ক এড়াতে প্রতিষ্ঠানটি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্প্রতি এ–সংক্রান্ত সুপারিশ পিএসসিতে জমা দেওয়া হয়েছে।

পিএসসি সূত্র জানায়, বিসিএসের সময় কমিয়ে আনাসহ বিভিন্ন জটিলতা কমাতে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ধরনের বেশ কিছু কমিটি করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রশ্ন যাচাই কমিটিও করা হয়েছে। কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে এই কমিটির সদস্য করা হয়েছে। এই কমিটি সম্প্রতি কয়েকটি সভা শেষে পিএসসি চেয়ারম্যানের কাছে বেশ কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করেছে। চেয়ারম্যান সেই সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটিতে আছেন, পিএসসির এমন এক বিশেষজ্ঞ সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, পিএসসি কেবল ক্যাডার নিয়োগ দেয় না। বিভিন্ন ধরনের নন–ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষা ও সরকারি চাকরিজীবীদের পদোন্নতিসংক্রান্ত বিভাগীয় পরীক্ষাও নিয়ে থাকে। সেসব পরীক্ষায় যাতে প্রশ্ন নিয়ে কোনো বিতর্ক না থাকে, সে জন্য আমরা কিছু সুপারিশ করেছি। এসব সুপারিশ পিএসসি চেয়ারম্যানকে দেওয়া হয়েছে।

সুপারিশে কী কী আছে জানতে চাইলে ওই সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, এমসিকিউ বা বহুনির্বাচনী প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে একই প্রশ্নের যেন একাধিক উত্তর না থাকে, সেটি লক্ষ করতে পরীক্ষকদের সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে। কেননা এ ধরনের প্রশ্ন পরীক্ষার্থীদের যেমন বিভ্রান্ত করতে পারে, তেমনি নম্বর কম পাওয়ারও সম্ভাবনা তৈরি হয়। এ ধরনের উত্তর দিতে বৃত্ত ভরাট করতেও সময় বেশি লাগে পরীক্ষার্থীর। তাই প্রশ্নের উত্তর একাধিক নয়, এমন প্রশ্ন করতে বলা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে সুপারিশে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন করার সময় বারবার ইতিহাসনির্ভর গ্রহণযোগ্য বই দেখে প্রশ্ন করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ইতিহাস বিকৃত হয়, এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে বলেছে কমিটি।

এসব ছাড়া বহুনির্বাচনী ও লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক উসকানি তৈরি হতে পারে বা সম্পর্কের অবনতি হতে পারে, এমন প্রশ্ন না করার পক্ষে জোর মত দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞ কমিটি এ প্রসঙ্গে বলেছে, এ ধরনের প্রশ্নের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সেখান থেকেও সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব তৈরি হতে পারে। তাই প্রশ্নে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের অবনতি হয় বা বিতর্ক হয়, এমন প্রশ্ন রাখা যাবে না।

এ ছাড়া দেশের কোনো সামাজিক দল বা গোষ্ঠী হেয় হয়, এমন প্রশ্নও করা যাবে না। কোনো বিশেষ সম্মানিত ব্যক্তিকে নিয়ে বিতর্ক হয়, এমন প্রশ্ন করা যাবে না।

প্রশ্ন কমিটির সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য কোনো দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নষ্ট হয়, এমন প্রশ্ন এড়িয়ে যেতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কমিটি বলেছে, ভারত-বাংলাদেশ, বা বাংলাদেশ-মিয়ানমারের বিদ্যমান সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে এমন প্রশ্ন এড়াতে এ বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন করার ক্ষেত্রে প্রশ্নকর্তাদের একটি বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে বলেছে বিশেষজ্ঞ কমিটি। এটি হচ্ছে, প্রশ্নে এমন কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, যার উত্তর পরীক্ষকের মত বা বিশ্বাসের ওপর প্রভাব ফেলে। অর্থাৎ পরীক্ষক যেন তাঁর মতের ওপর নির্ভর না করে প্রশ্নের নম্বর দেন, তা লক্ষ রাখতে হবে। বিষয়টি জানতে চাইলে কমিটির এক সদস্য বলেন, এমন কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, যার উত্তরে খুশি হয়ে এক পরীক্ষক বেশি নম্বর দিলেন, আবার অন্য পরীক্ষক নাখোশ হয়ে পরীক্ষার্থীকে কম নম্বর দিলেন। পরীক্ষকের মত (পারসেপশন) প্রকাশ পাওয়ার মতো প্রশ্ন করা যাবে না।

প্রতিটি বিসিএস পরীক্ষা, নন–ক্যাডার ও বিভাগীয় পরীক্ষা শেষে প্রশ্ন কমিটিকে সব প্রশ্ন পর্যালোচনা করার কথাও সুপারিশ করা হয়েছে। পরীক্ষাগুলোর প্রশ্নে কোনো ভুল হলো কি না, তা শনাক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রশ্নকর্তাকে সেই ভুল ধরিয়ে দিয়ে শোধরানোর সুপারিশও করা হয়েছে। বারবার সতর্ক করার পরও যদি প্রশ্নকর্তা আবারও ভুল করেন, সে ক্ষেত্রে ওই প্রশ্নকর্তাকে বাদ দিতে বলেছে পরীক্ষা কমিটির বিশেষজ্ঞ দল। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, কোনো পরীক্ষার প্রশ্ন যেহেতু পরীক্ষার আগে পিএসসির কেউ দেখতে পারেন না, তাই পরীক্ষার পর

প্রশ্ন নিয়ে পর্যালোচনার সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রশ্নের বিষয়ে সুপারিশগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্ন বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামনে পিএসসি থেকে যত নিয়োগ ও বিভাগীয় পরীক্ষা নেওয়া হবে, তাতে প্রশ্নকর্তাদের এসব বিষয় মেনে প্রশ্ন প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া হবে। কেউ না মানলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ওই প্রশ্নকর্তাকে ভবিষ্যতে কোনো প্রশ্ন করতে না দেওয়ার মতোও সিদ্ধান্ত নেবে পিএসসি। তবে সোহরাব হোসাইন মনে করেন, কেবল পিএসসি নয়, সবারই প্রশ্ন করার বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত। এমন প্রশ্ন করতে হবে, যা নিয়ে বিতর্ক হবে না।

মোছাব্বের হোসেন

সূত্র-প্রথম আলো