ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, সাইপ্রাস, এস্তোনিয়া, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, মাল্টা, নেদারল্যান্ড, পর্তুগাল, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া এবং স্পেন এই ১৯টি দেশ নিয়ে গঠিত ইউরো জোন। এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন সুদের হার এবং নিম্ন মুদ্রাস্ফীতির কারণে ভালো অর্থনৈতিক অবস্থানে ছিলেন ইউরো জোনের মানুষরা। কিন্তু বর্তমানে ভোক্তা মূল্য সূচক বার্ষিক ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যেখানে ইউরোপীয় সেন্ট্রাল ব্যাংকের (ইসিবি) লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশ। ব্যাংকের গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যরা সুদের হার বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে এবং আগামী ৯ জুন অর্থনৈতিক পলিসি সংক্রান্ত বৈঠকে সেটি নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু ইসিবি নিজেই এখন একটি জটিল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমনটি চলতে থাকলে শুধু দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া নয়, প্রবৃদ্ধি অর্জনেও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।

এ দুটি বিষয়কে জটিল করে তুুলেছে জ্বালানির তীব্র সংকট। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের আগে থেকেই তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়তে থাকে ইউরো জোনে, যুদ্ধের কারণে আরও কয়েক দফা দাম বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান পণ্যের দাম আমেরিকার তুলনায় ইউরোপে ভোক্তা-মূল্যের মুদ্রাস্ফীতি বাড়াতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে। মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংকিং সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকসের তথ্য বলছে, ইউরো অঞ্চলে জ্বালানির দাম-যা মে মাসে বার্ষিক ৩৯ শতাংশ হারে বেড়েছে। এটি আমেরিকার দুই পয়েন্টের তুলনায় মুদ্রাস্ফীতিতে প্রায় চার পয়েন্টের বেশি দাঁড়িয়েছে।

অন্যান্য ভোক্তা মূল্য সূচককেও প্রভাবিত করে এই মুদ্রাস্ফীতি। গত মে মাসে ইউরো জোনে অর্থনীতিবিদদের ধারণাকে ছাড়িয়ে গেছে মুদ্রাস্ফীতি। গত বছরের তুলনায় এপ্রিল মাসে জার্মানিতে উৎপাদন খরচ ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। শুধু তেল, গ্যাস নয়, ধাতব দ্রব্য কংক্রিট ও রাসায়নিকের মতো পণ্যেরও দাম বেড়েছে। এসব কারণে ব্যবসার খরচ এবং পরিবারের ক্রয় ক্ষমতার ওপর একটি বড় আঘাত এসেছে। এটা ইউরো অঞ্চলের অর্থনীতিকে কতটা বিপদের মধ্যে ফেলে সেটাই দেখার বিষয়।

এরই মধ্যে জ্বালানির আকাশচুম্বী দাম বিপদে ফেলেছে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে। মজুরি ইউরো জোনজুড়ে বাড়ানো হয়েছে, তবে এখনও মুদ্রাস্ফীতির কারণে স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে রয়েছে। কিছু নিয়োগকর্তা কর্মীদের একদফা অর্থ প্রদান করেছেন, দাম ও খরচের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। নেদারল্যান্ডসে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি করা হয়, উদাহরণস্বরূপ, ব্যবসায়িক মনোভাব চাঙা এবং কঠোর শ্রমবাজার থাকা সত্ত্বেও গত মে মাসে মাত্র ২ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে সেটি। এক অর্থে, এটি ইসিবির জন্য সুসংবাদ, কারণ এটি মজুরি-মূল্য সর্পিল হওয়ার ঝুঁকি কমায়।

অবকাঠামোগত খাত এরই মধ্যে অসুবিধায় পড়েছে। চীনের সম্প্রতি লকডাউন জারি এবং জ্বালানির উচ্চমূল্যের ফলে নতুন করে সরবরাহে বিঘ্ন ঘটছে যা ব্যবসায় ধস এনেছে। জার্মানি পূর্ব ইউরোপে শিল্প মন্দার জন্য সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত মে মাসে ইউরো জোনের ম্যানুফেকচারিং কোম্পানিগুলোর ২০২০ সালের জুনের পর নতুন অর্ডার প্রথমবারের মতো কমেছে, যা দুর্বল চাহিদার নির্দেশক। রপ্তানি আদেশ দুই বছরের মধ্যে দ্রুত গতিতে হ্রাস পেয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা তাই বছরের বাকি অংশে ধীরগতিতে প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দিচ্ছেন। তবে এখনই মন্দার আশঙ্কা করছেন না তারা। কারণ অর্থনীতির কিছু অংশ দুর্বলতার পরিবর্তে শক্ত অবস্থান থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণে লকডাউন শেষ হওয়ার পর অনেক সেবা প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। পর্যটনের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে দক্ষিণের দেশগুলো সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে। গত এপ্রিলে স্পেনে পর্যটকদের আনাগোনা করোনা মহামারির পূর্বের মতো বেড়ে গেছে। সামগ্রিকভাবে, সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাঙা ভাব বিরাজ করছে।

চাকরির বাজার এখনও অপর্যাপ্ত। ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে একশ চাকরির বিপরীতে তিনটি পদ ফাঁকা ছিল, ইতিহাসে যেটি সর্বোচ্চ। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সামান্য দুর্বল হলেও ব্যবসার নিয়োগের প্রত্যাশা দৃঢ় হচ্ছে। ইউরোপের চারটি ব্যবসার মধ্যে একটিতে লোকবলের অভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

লকডাউন চলাকালীন সঞ্চয় ভোক্তাদেরকে কিছুটা সুরক্ষা দিচ্ছে। পরিসংখ্যানের ডেটা বলছে, ফ্রান্স ও জার্মানিতে এ ধরনের ‘অতিরিক্ত’ সঞ্চয়ের পরিমাণ ছিল ২০২২ সালের প্রথম প্রান্তিকে পরিবারের নিষ্পত্তিযোগ্য আয়ের প্রায় দশমাংশ। এ সঞ্চয় কিছুটা কাজে দেবে কিন্তু এটি সম্পূর্ণভাবে সমস্যা সমাধান করবে না। অতিরিক্ত সঞ্চয় সমানভাবে কাজে লাগেনা। ধনী দেশগুলোতে দরিদ্র মানুষ এবং দরিদ্র দেশগুলোর বেশিরভাগ পরিবারের কাছে মূল্যবান সঞ্চয়ের সামান্য অবশিষ্ট থাকে। উদাহরণস্বরূপ, স্লোভাকিয়ায়, মহামারি চলাকালীন সঞ্চয়ের হার কখনই খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি এবং এখন এটি দীর্ঘমেয়াদী গড় আয়ের থেকে অনেক কম।

অনেক দেশের সরকার বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে পরিবারগুলোকে রক্ষা করার জন্য প্রচুর ব্যয়ের কর্মসূচি নির্ধারণ করেছে। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্রুগেলের তথ্য অনুযায়ী, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি এবং অন্যান্যরা জিডিপির এক থেকে দুই শতাংশ ব্যয় করে। এসব আর্থিক প্রণোদনাকে ভালো লক্ষণ ধরা হয়না। এর বেশির ভাগই যায় স্বচ্ছল পরিবারে যা তাদের প্রয়োজন নেই।

যদি ইউরো অঞ্চল একটি মন্দা থেকে রক্ষা পায়, তবুও জ্বালানির সংকট অর্থনীতিতে আরও বিপর্যয় আনবে। খাদ্য ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে ইউরোপের অর্থনীতি।

সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট

DISCLAIMER : Views expressed above are the author's own. The contents provided here are only for educational assistance & information purposes only. Information is provided without warranty and is to be used at the risk of the reader. All trademarks, logos and copyright issues are property of their respective owners. The creator of this page takes no responsibility for the way you use the information provided on this site.